অবতক খবর,৩ ডিসেম্বরঃ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “আমরা প্রায় সময়মতো সভা শুরু করেছি। আসতে আসতে দেখেছি, সভা ঘিরে মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা, উৎসাহ। অন্তত পক্ষে পাঁচগুণ মানুষ সভাস্থলে এসে পৌঁছাতে পারেননি। রাস্তায় রয়েছেন। পূর্ব মেদিনীপুর আমরা যখনই সভা করি। আমাদের জায়গাটা বরাবরই একটু ছোট হয়ে যায়। আমি বিধানসভা নির্বাচনের আগে পূর্ব মেদিনীপুরে সভা করেছিলাম। তখনও নির্বাচন ঘোষণা হয়নি। আজ যাঁরা সভাস্থলে উপস্থিত রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই সময় অনেকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, অনেকের মনে ভয়-ভীতি রয়েছে যে নির্বাচনে কী হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যার উপর ভরসা করে জেলার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন, তিনি তো নিজের গা বাঁচাতে, বিশ্বাসঘাতকতা করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।এবার তৃণমূলের কী হবে।”
রাজ্যে তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূলের সরকার গঠনের জন্য জেলাবাসীকে ধন্যবাদ জানান অভিষেক। বললেন, “আমি ধন্যবাদ জানাই পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬টি আসনের মধ্যে ৯টি আসন এবং অবিভক্ত মেদিনীপুরের (পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম) ৩৫টি আসনের মধ্যে ২৬টিতে জিতিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী করেছেন। সবাইকে আমি নতমস্তকে করজোড়ে প্রণাম জানাচ্ছি।”
অভিষেক বলেন, “বছরখানেক হয়ে গিয়েছে আমি কাঁথিতে এসেছি। যদিও আমি কিছুদিন আগে হলদিয়ায় বৈঠক করে গিয়েছি। যাঁরা হলদিয়া থেকে এই সভায় এসেছেন, তাঁরা বুকে হাত দিয়ে বলুন হলদিয়ায় সেই বৈঠকের পর পরিবর্তন হয়েছে কি না। আর কোনও দাদাকে ধরে টাকার বিনিময়ে চাকরি হয় না। যখন সিওডি হয়, শ্রমিকের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সেই জনমুখী ভাবনা, কর্মসূচি আপনারা লক্ষ্য করেছেন।”
হলদিয়ার সভা থেকে তিনি যে ঠিকাদারি ছাড়ার কথা বলেছিলেন তৃণমূলের কর্মীদের, সেই বার্তাও এদিন আবারও দিলেন অভিষেক। বললেন, “হয় ঠিকাদারি করুন, নাহলে তৃণমূল কংগ্রেস করুন। দুটো একসঙ্গে হবে না। আমরা সেটি বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছি। যেভাবে দল হলদিয়ায় পরিচালিত হয়েছে, আগামী দিনে সারা বাংলায় সেভাবেই পরিচালিত হবে।”
নতুন তৃণমূলের যে কথা এর আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার সরব হয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গও এদিন উঠে আসে কাঁথির সভামঞ্চে। বললেন, “সাধারণ মানুষ যে তৃণমূলকে দেখতে চায়, আমরা সেই তৃণমূল গড়তে বদ্ধপরিকর। ঠিকাদাররা যেভাবে দেখতে চায়, সেভাবে নয়। আমরা দায়বদ্ধ মানুষের প্রতি।”
মেদিনীপুরের বীর সন্তান কেমন হয়, সেই কথাও এদিন বললেন তৃণমূলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। সভামঞ্চে বক্তৃতা দেওয়ার আগে ক্ষুদিরাম বসু প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেছিলেন তিনি। সেই কথা টেনে বলেন, “শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ছবি বা মূর্তি আপনারা যেখানে দেখবেন, নজর করবেন, তাঁর মাথা আকাশের দিকে। বীরের মতো তাঁকিয়ে রয়েছেন। বুক চিতিয়ে। এই হল মেদিনীপুরের বীর সন্তান।”
ক্ষুদিরাম বসুর কথা বলে পরক্ষণেই অভিষেক বললেন, “মেদিনীপুরের মান-সম্মান, ঐতিহ্য, ভূলুণ্ঠিত করে নিজেদের ঘাড় আর পিঠ বাঁচাতে বিজেপির নেতাদের পায়ে ধরে এই ডিসেম্বর মাসেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছিল, তাঁদের মেদিনীপুরের মানুষ ক্ষমা করবে না।”
পূর্ব মেদিনীপুরের সঙ্গে তাঁর টান বোঝাতে গিয়ে অভিষেক বলেন, “হয়ত আমি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছি, কলকাতায় থাকি। মাতঙ্গিনী হাজরা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সতীশ সামন্ত, সুশীল ধারা, অজয় মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র শাসমলদের জীবন অধ্যায় পড়লেই বোঝা যায়, এই মেদিনীপুরের মানুষকে বীরত্ব শেখাতে হবে না। আট থেকে আশি, সবাই বুক চিতিয়ে মেদিনীপুরের বুকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।”
অতীতে ডিসেম্বর মাসেই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার তৈরি হয়েছিল। সেই ডিসেম্বর মাসেই যে শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, সেই কথাও স্মরণ করিয়ে দেন অভিষেক। বললেন, “মীর্জাফরের নাম করে যেমন মানুষ টোন-টিটকিটি করে, বিশ্বাসঘাতক বোঝাতে যেমন মীর্জাফরের কথা তুলে আনে, ঠিক তেমনিভাবে পূর্ব মেদিনীপুরের বিশ্বাসঘাতককে ৫০০ বছর বাংলার মানুষ মীর্জাফর, গদ্দার বলে সম্বোধিত করবে।”
ডিসেম্বর মাসে বড় কিছু রাজনৈতিক ঘটনার ইঙ্গিত বার বার শোনা গিয়েছে বিজেপির নেতাদের গলায়। এবার সেই ডিসেম্বর মাসের জন্যই বড় কর্মসূচি ঠিক করে দিলেন অভিষেক। বললেন,”আগামিকাল সকাল থেকে মেদিনীপুরের প্রত্যেকটি এলাকা, প্রত্যেকটি ব্লকে-বুথে মিছিল মিটিং আয়োজন করুন। ডিসেম্বর মাস জুড়ে আগামিকাল থেকে শুরু হবে বিশ্বাসঘাতক ও বেইমানমুক্ত মেদিনীপুর।”
শুভেন্দু অধিকারীর নাম নাম করে অভিষেক বলেন, “কথায় কথায় বলে আমার পরিবার তো ব্রিটিশ তাড়িয়েছে। যাঁর পরিবার ব্রিটিশ তাড়ায়, তিনি অমিত শাহর পায়ে হাত দিয়ে বিজেপিতে যোগ দেবে? ন্যূনতম বিবেক ও আত্মসম্মান যদি থাকে, বাংলার গণআন্দোলনের প্রতি যনি ন্যূনতম সম্মান থাকে… আপনারা কি চেয়েছিলেন যাঁরা ব্রিটিশদের দালালি করেছিল, মেদিনীপুরের একজন সন্তান তাদের পায়ে হাত দিয়ে বিজেপিতে যোগ দিক?”
নন্দীগ্রামের বিধায়কের নাম না করে অভিষেক বলেন, “আমি বাইরে বেরোলেই তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছে। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে খালি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর আমার নাম নিতে পারে না। ভাববাচ্যে কথা বলে। কারণ, নাম নিলে তো মামলা করা যায়। সেই জন্য নাম নিতে পারে না। এই রাজ্যে সবথেকে বড় ঘুষখোর, তোলাবাজের নাম কী?”
অভিষেক বলেন, “কলেজের গার্লস হোস্টেল তৈরি হচ্ছিল ২০১৫ সালে। ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার টেন্ডার বেরিয়েছিল। যা বলি বুক ঠুকে বলি, যদি মিথ্যা বলি আমার বিরুদ্ধে মামলা করবেন। গার্লস হোস্টেলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান যিনি ছিলেন, তাঁরাও এই মিটিং দেখছেন। ২০০ মিটার দূরেই তো বাড়ি। কেউ মোবাইলে দেখছেন, কেউ টিভির পর্দায়, কেউ মাইকে শুনছেন। ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার টেন্ডারের কাজে কোনও নিয়ম ছাড়া ২ কোটি ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল।” তরুণীতা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি অভিষেকের।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বলেন, “কথায় কথায় আমাকে তোলাবাজ বলে, আমাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। আজ ৩ তারিখ। আগামী ৫-৮ তারিখ দিল্লিতে থাকব। আমি ১৫ দিন সময় দিয়ে গেলাম। এই কলেজের মাঠে আবার মিটিং হবে। তুমি তোমার খাতা নিয়ে আসবে, আমি আমার খাতা নিয়ে আসব। মানুষের সামনে যদি উলঙ্গ না করতে পারি, আর রাজনীতির ময়দানে পা রাখব না।”
পূর্ব মেদিনীপুর জেলাকে অধিকারীগড় হিসেবেও বলতে পছন্দ করছেন না অভিষেক। বললেন, “কীভাবে অধিকারী গড়? যদি ১৬টার মধ্যে ৯টা তৃণমূল পায়… পুরভোটেও হলদিয়া ও পাঁশকুড়া বাকি রয়েছে। অন্য তিনটিতেই তৃণমূল জিতেছে। তাহলে অধিকারী গড় কীভাবে? এটা তৃণমূলের গড়। আমি কারও গড়ে আসিনি। আমি পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষের গড়ে এসেছি। আমি তো ভেবেছিলাম বুক চিতিয়ে লড়াই হবে। আমার কথা শুনবে। সে তো লেজ গুটিয়ে ডায়মন্ড হারবারে পালিয়েছে। এবার সেখানে বলছে ডেকরেটার পাচ্ছে না। বলছে অভিষেকের লোকেরা মিটিং করতে দিচ্ছে না। আপনি এক ডাকে অভিষেকে ফোন করুন। আমি আপনার ডেকরেটর নিয়ে যাব। আপনার লোক নেই, সংগঠন নেই, উদ্দেশ্য নেই… কী করে লোক হবে? আপনি তো ফুটেজ খেতে গিয়েছেন।”
অভিষেক বললেন, “ফুটেজ খেতেও আমার নাম। শিরোনামে থাকতেও আমার নাম। আপনি আমার নাম ব্যবহার করুন। যতবার অভিষেক বলবেন, ততবার অক্সিজেন পাবেন। কিন্তু আমাকে আক্রমণ করতে করতে শালীনতার গণ্ডি পেরিয়ে আমার স্ত্রী, শ্যালিকাকে আক্রমণ করলেন। আমার তিন বছরের ছোট্ট শিশু সন্তানকেও ছাড়েনি। যাঁরা আমাকে ছোট করতে গিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষকে অপমান করছে, এই লজ্জা তৃণমূলের লজ্জা নয়, এটা পূর্ব মেদিনীপুরের লজ্জা।”
কাঁথিতে অভিষেকের সভার আগের রাতেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিস্ফোরণ নিয়ে জোর চর্চা চলছে রাজ্য রাজনীতিতে। চলছে রাজনৈতিক আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। অভিষেক বলেন, “কথায় কথায় বলছে, ডিসেম্বরে এই হবে, সেই হবে। আজ বুঝতে পারলাম, কী হবে। উনি নিজে টুইট করে বলেছেন, যে বোমটি কাঁথিতে মারার কথা ছিল, সেটি ফেটেছে। তার মানে কী? আজকের সভায় কী প্ল্যান ছিল? এটাই ডিসেম্বর ধামাকা? তাই তো? তুমি কি ভাবছো, তুমি কোথায় কালীপটকা ফাটাবে, আর অভিষেক ভয়ে পালাবে? তুমি লেজ গুটিয়ে পালানোর পার্টি, আমি বুক চিতিয়ে লড়ার পার্টি।”
অভিষেক এদিন মারিশদায় গ্রাম ঘুরে দেখার কথাও তুলে ধরেন। বলেন, “মারিশদার ৫ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান কখনও যায়নি । আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান, উপপ্রধান, অঞ্চল সভাপতির পদত্যাগপত্র চাই। যদি না হয়, তাহলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করব।” আগামী এক মাসের মধ্যে দলীয় নেতা ও কর্মীদের ১০টি করে গ্রামে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, “তৃণমূলের প্রতীকে জিতব, আর বিজেপির দালালি করব… তা হবে না। তৃণমূলের প্রতীকে জিতে দু’জন বাড়িতে আছে। তৃণমূলের প্রতীকে জিতে বিজেপির সঙ্গে কানামাছি ভোঁ ভোঁ। ২০০ মিটার না , এরপর ২০ মিটারের মধ্যে সভা করব।”
অভিষেকের চ্যালেঞ্জ, “ওর শত্রু অভিষেক। ক্ষমতা থাকলে আমাকে জেলে ঢোকাও। আমি কিছু না করে চার বছর যদি জেলে যেতে হয় , তাহলে আপনার তো ৪০ বছর জেল হওয়া উচিত।”