পোড়খাওয়া এই দেশ
তমাল সাহা
ধ্বংসাবশেষের মধ্যে জেগে থাকে দেশ।
মনে হয় তার মৃত্যু হয়েছিল। খুঁড়ে পাওয়া যায় স্নানাগারের বিশাল চবুতরা, ভগ্ন প্রাসাদোপম অট্টালিকা। মানুষেরা এখানে স্নান করেছিল, বাস করেছিল একদিন।
শিক্ষার যাবতীয় উপাদান কর্পোরেটের হাতে চলে গেলে মনে হয় মৃত্যু হয় দেশের। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাঙা দেয়াল কোঠাবাড়ি শীলভদ্রের কথা মনে পড়ে আর যখন জানতে পারি ফা হিয়েন হিউয়েন সাঙেরা এই পথে হেঁটেছিল তখন মনে হয় জেগে আছে এই দেশ।
চৌদ্দবার গণধর্ষিতা যৌনাঙ্গে রক্তস্রোত নিয়ে বিলকিস বুঝি মরে যায়!তা হবে কেন? চৌদ্দটি চেনা মুখ পড়শি ধর্ষক ছাড়া পেলেও দেশের মানুষের কাছে তারা মৃত চেহারা নিয়ে চলাফেরা করে। বিলকিসের মুখটি সজীব সোচ্চারে জেগে থাকে। এইভাবে বেঁচে থাকে মহাভারতীয় উপকূলে এই দেশ।
দলিত কিশোরটি জলভাণ্ড ছুঁয়ে জল পান করেছিল। তাকে পিটিয়ে মারলেও পানপাত্রটি জেগে থাকে ইস্কুলের জলঘরে।
এই দেশ বারবার আহত হয়, নিহত হয়। কারাগারে জেগে থাকে কবি ও কলম।
ইটভাটার ঝোপড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সুকুমারী দেবীর মুখ। মাথা গোঁজার ঠাঁই চাইতে গেলে সে গ্রেফতার হয়ে যায়। লক আপে তার গলায় পুলিশের বুটের চাপ পড়লে সে মরে যায় না। সে যখন শাড়ি তুলে লাঠিপেটার দাগ দেখায় তখন আবার যাক যাজ্ঞসেনীর জন্ম হয়।
সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের পরিষেবাকে তুড়ি মেরে কালাহান্ডির দানি কালি মাঝি কালাহান্ডির দানি মাজি,সরগুজার ঈশ্বর দাস ক্রান্তির রামপ্রসাদেরা প্রিয়তমা নারীদের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকে রুদ্র নটরাজের বিভঙ্গে তখন মৃত্যুর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী এক ভারতবর্ষের জন্ম হয়।
পৃথিবীর আদিতম আবিষ্কার আগুন। যাপিত জীবনকে স্বাদুতর করে তুললেও দাঙ্গার অগ্নিকাণ্ডে মানুষেরা মারা যায়, ঘরবাড়ি জ্বলে ওঠে।তারই মধ্যে অরণ্যের অন্তরালে অগ্নি স্বাহা উচ্চারিত হয়। কারা গেয়ে ওঠে গান! পাখিদের কলরব শোনা যায়। ডানায় রোদ্দুরের আলো নিয়ে তারা আকাশে উড়ে যায় ভারতবর্ষের জলাশয় গুলিতে শস্য খেতে জনপ্রান্তরে আহার্যের সন্ধানে নেমে পড়ে।
শীতের সন্ধ্যায় মন্দিরে নাম-সংকীর্তন হয়।
মাজারে চিরাগ জ্বলে। মুশকিল আসান বাবার পাশে মানুষেরা এসে বসে।
রাতের গভীরে কুয়াশার ভিতর উঁচু গির্জার মাথায় ঘন্টাধ্বনি শোনা যায়।
জেটি ছেড়ে জাহাজটি পাড়ি দিতে থাকে। জল ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের বুকে।
মধ্যরাত্রে দ্বিখন্ডিত বুকে রক্তস্নাত ভারতবর্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক চেতনা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
সেই কবে কাল থেকে ভারতবর্ষ ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত হতে থাকে।
কেউ জানে না এই চিরসত্য– ভারতবর্ষ মৃত্যুঞ্জয়ী। মার খাওয়াই তার ধর্ম। মার খেতে খেতে পোড়খাওয়া ভারতবর্ষ জন্ম থেকে জন্মান্তরের দিকে হাঁটতে থাকে, হেঁটে যায়….