নকশালবাড়ি আন্দোলনের নায়কের আজ জন্মদিনঃ
অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

তরাইয়ের বৃক্ষগুলি প্রশ্ন করে বলো তো চারুকলা কাকে বলে?
তমাল সাহা

তরাইয়ের অরণ্য সাম্রাজ্যে মাথাউঁচু বৃক্ষগুলি এখনো ঋজুভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আকাশকে আর যে উদ্ভিদসমূহ ডালপালা ছড়িয়ে ঝুলে আছে তারা মাটিকে প্রশ্ন করে, বলতো চারুকলা কাকে বলে?
মার্তণ্ডের প্রখর রৌদ্রে এবং চন্দ্রিমার আলোয় তারা এখনো এই জিজ্ঞাসা রেখে যায়।

এই জলছোঁয়া পাথুরে মাটিতে শাঙ্কবাকার সটান আকৃতি নিয়ে দেবদারু গাছ নয় বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়েছিলে তুমি। এই বৃক্ষকে কী চিরহরিৎ বৃক্ষ বলা যায়? এই বৃক্ষ কী পর্ণমোচী প্রজাতির? এর যথার্থ উৎস স্থল কী? এই বৃক্ষ বল্কল পরিত্যাগ করতে পারে কী? মাটি খেয়ে বুঝি তোমার মা তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছিল! সেই তেভাগা আন্দোলন থেকে আমি তোমার লড়াকু মুখ দেখেছিলাম। আমি জানি মাটি নারী। তাকে মৃত্তিকা বলে। তার গায়ে কোন্ ভালোবাসার গন্ধ পেয়েছিলে তুমি?

বাম বা ডান, উত্তরপন্থী না দক্ষিণপন্থী, কতসব রাজনৈতিক দল শোধনবাদী, সংশোধনবাদী, নয়া সংশোধনবাদী কতসব শব্দ নিয়ে তোমার উপর হামলে পড়েছিল। সদর্থক অথবা নৈর্ব্যক্তিক কোন ভূমিকায় ছিলে তুমি? তুমি খুবই খারাপ মানুষ, মন্দ জনে কয়।
সেই সব বারুদ মজুত, লাশের স্তুপ,তীর-ধনুক,পিস্তল-পাইপগানের যুদ্ধ, রক্ত নদীর গল্প বলতে আমি আসিনি। এসবের হিসেবনিকেশও নয়, আমি এর মূল্য বা ঋণ পরিশোধে বসেছি। কোল খালিকরা মায়েদের হা হুতাশ ও আর্তনাদ আমি বর্ণনা করতে আসিনি। কারণ সেই মায়েরাও এখন মরে গেছে। এখন প্রজন্মদের কোলে নিয়ে শুয়ে আছে অন্য কোনোখানে।

নিশ্চিত তোমাকে কেন্দ্র করে বৃত্ত রচিত হয়েছিল। সে বিশাল ভৌগোলিক বৃত্তের পরিধিতে অস্ত্রবানেরা তো ছিলই, হাতে হয়তো অস্ত্র ছিল না, শস্ত্র নিয়ে অসংখ্য মানুষ ছিল‌। শুধু মানুষ নয় গাঁ গঞ্জের চাষাভুষো কল-কলকারখানার সাহসিক মজুরেরাও ছিল, ছিল নিতান্ত মুটে, মাঝি, ফেরিওয়ালা, রিক্সাওয়ালারাও। কারণ গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় গতিবিধি ও খোচরদের ক্রিয়া-কলাপ জানতে এই নিতান্ত ছাপোষা গরিব মানুষদের অত্যন্ত জরুরি ছিল।

আমি কোন রক্তাক্ত যুদ্ধের বর্ণনা দিতে আসিনি, আসিনি সন্ধ্যাবেলা দীপহা্তে বৈধব্যের বেশ পরিহিত রমণীদের বর্ণনা দিতে যারা বিধ্বস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে দেখতে এসেছে নিহত স্বামী পুত্রের মুখ।
আমি খতম অভিযানের বিরুদ্ধে কথা বলতে এসেছি।

সংগ্রাম ও সংস্কৃতি পরস্পরের পরিপূরক– এই বাক্য বিন্যাস স্লোগানের মতো পড়ে গেছি কিন্তু সংগ্রামকে কেন্দ্র করে কিভাবে সাহিত্যের নির্মাণ হয় এই গাঙ্গেয় উপত্যকায় তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। সংগ্রামকেও পণ্য করা যায় কিনা তা নিয়ে আমার মনে প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছে। তুমি বৃত্তের কেন্দ্রস্থলে না থাকলে কী এই বজ্রবাহী বিস্ফোরণ ঘটতো? বঙ্গীয় ময়দানে এইসব পেশাজীবী সাহিত্য কর্মী তারা কী একবারও তোমাকে সেলাম ঠুকেছে? তারা পণ্যবাহী জাহাজে করে মুদ্রা নিয়ে গিয়েছে বা লোকচক্ষুর সম্মুখে শিল্পী হিসাবে নন্দিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় শিরোপায় বন্দিত হয়েছে। তাদের যে আসল ক্যাপিটাল যে মূলধন সেই সময়, তা তো নির্মাণ করেছিলে তুমি!

হাজার চুরাশির মা, অগ্নিগর্ভ, মহাকালের রথের ঘোড়া, শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে, প্রতিদ্বন্দ্বী, আটটা নটার সূর্য, গৃহযুদ্ধ, কালবেলা, আমি ও বনবিহারী, অজ্ঞাতবাস, হাওয়া গাড়ি, এক রাজনীতির জীবন, নকশালবাড়িনামা, মৃত্যুকুসুম, স্বপ্নযুগ এবং আরো অনেক এরূপ সাহিত্য উপন্যাসের সৃজন প্রক্রিয়ার মূল আয়োজক তো আসলে তুমি। এসব নাকি সময়ের দলিল দস্তাবেজ! তারা এখন নামজাদা সুপরিচিত সাহিত্যিক। অনেকে মারা গিয়েছে, অনেকে বেঁচের্তে আছে।

তুমি না থাকলে কি করে এইসব আন্তর্জাতিকখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ কারিগরদের আমরা পেতাম? কলকাতা ৭১, পদাতিক, কোরাস, প্রতিদ্বন্দ্বী, যুক্তি তক্কো গল্প, গৃহযুদ্ধ এসব চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ে‌ এর অন্তরালে রয়েছে তোমার সৃজনশীল আগ্নেয় উত্তাপ।
আর নাট্যশিল্প? চাকভাঙ্গা মধু, পদ্য গদ্য প্রবন্ধ, কলকাতার হ্যামলেট আরো কত নাটক — বিস্ময়কর মঞ্চায়িত ঘটনা।
আসলে তোমার উন্মাদনাতেই গড়ে উঠেছিল অঙ্গন মঞ্চের নাটক, তিন দিক থেকে মানুষকে ঘিরে ফেলা নাট্য রীতি।

মহান একজন মহান চিত্র পরিচালক উচ্চারণ করলেন, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো। অন্যজন রীতিমতো নির্দেশ দিলেন, ভাঙো, ভাঙা প্র্যাকটিস করো।

অসংখ্য সিনেমা গল্প প্রত্যক্ষ করেছি সেই সময়ের প্রতীক ফুল প্যান্ট বা পাজামার উপর পাঞ্জাবি পরিহিত কাঁধে সাইড ব্যাগ কোনো শ্মশ্রুবান তরুণকে চরিত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেয়া হয়েছে। কে সেই চরিত্রের চরিত্রায়ন করেছে? নকশালবাড়ির চিন্তায় আস্থাবান চারুপন্থী একজন যুবক। এক দশকের একটি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নকশালবাড়িকে বিধৌত করে শিল্প ও সাহিত্য সংস্কৃতি তখন গড়ে উঠেছে একথা অস্বীকার করা যায়? নকশালবাড়ি কি পেটের দানাপানি ও মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হয়ে ওঠেনি? লিখনশৈলীতে একটি দশকে তোমার অনিবার্য উপস্থিতি, তোমার সম্মানিত আত্মত্যাগ বাংলা শিল্পসাহিত্য অস্বীকার করতে পারে? এবং আজও তা বহমান।

দেওয়াল লিখন যদি শিল্প হয়ে থাকে সে যদি সৃজনশীল রাজনৈতিক চারুকলা হয়ে থাকে সেই শিল্পের স্রষ্টা তো তুমি।

হায়! তুমি নাকি খতম অভিযানের নায়ক ছিলে। আর এই স্বঘোচিত রাষ্ট্র ঘাতকের হাত ধরেই অন্য ধারার সাহিত্য শিল্পের সৃজন ঘটেছিল যা ছিল মানুষের স্বার্থে যথার্থ‌।

তখন দেওয়ালগুলি কেমন ভাষা যুগিয়েছিল?

দেওয়াল

দেওয়ালগুলিও এখন বিষাদ লেখে। বোধহয় বিষণ্ণ চোখে তারা মাথা নিচু করে থাকে।

বন্দুকের নলই রাজনৈতি…. লিখতে লিখতে উপুড় হয়ে পড়ল তরুণটি। গুলিটা পিঠ ফুঁড়ে দেওয়ালে গিয়ে লাগলো। হাতের ব্রাশ আর ভুসোকালির মালসা ছিটকে গেল।
অদূরে শব্দ শুনে কুকুর-কুকুরী এত ভীত হয়ে পড়ল, সঙ্গমের পালা ভেস্তে দিয়ে দ্রুত দৌড়ে গলির ভেতরে পালিয়ে গেল।

আমি
সেইসব দেওয়ালগুলির পাশ দিয়ে চলে যাই।
টেনসিলে মাও সে তুংয়ের মুখ,
যে চিত্রশিল্পী তৈরি করেছিল সেই মুখটি , তার হাতের নৈপুণ্য বা দেওয়াললিপির শব্দগুলি দেখতে থাকি।
কৃষি বিপ্লব ত্বরান্বিত করুন অথবা
শহীদের রক্তের নামে শপথ বা
বিপ্লবীকে খতম করা যায় বিপ্লবকে নয়—
সব অনুষঙ্গ ক্ষতচিহ্নের মতো জেগে ওঠে।

আমি হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানের দিকে চলে যাই।
মনে পড়ে এই দেওয়ালটিতে কোনোদিন লেখা ছিল, কমরেড তোকে ভুলছি না, ভুলবো না– স্মৃতিভারে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।

এখন আর সেই সব দেওয়াল নেই
অনেক দেওয়ালই প্রোমোটারের পাল্লায় আবাসনের দখলে চলে গেছে।
সেই বিশাল বিস্ময়ী দেওয়ালটি বেলেঘাটায় আছে কিনা জানিনা
যেখানে পিঠ ঠেকিয়ে চোখবেঁধে পাঁচটি যুবককে গুলি করেছিল ফায়ারিং স্কোয়াড।
দমদম প্রেসিডেন্সি আলিপুর হুগলি বহরমপুরের দেওয়ালগুলি এখনো আছে।
এই প্রাচীর টপকেই ওরা পালাতে গিয়েছিল।
ওরা নেই!
দেওয়ালগুলি ওদের রক্তের গন্ধ নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে…

এবং হতভাগ্য আমি!