পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বীজপুরে তিনবার পদার্পণ করেছিলেন
তমাল সাহা
১২ ফেব্রুয়ারি । ‘ ফুল ফুটুক না ফুটুক’-এর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন। ৮ জুলাই তার মৃত্যুদিন।
যে কবি ১৯৪৫ সালে ‘স্বাধীনতা’ বেরোনোর কাল থেকে কবি-সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছেন তাকে দেখা গেছে উত্তরবঙ্গের চা বাগিচায়, বজবজের শ্রমিক বস্তিতে কাজ করতে। কাগজ বেরুচ্ছে নতুন ধারায়, গদ্যের রিপোর্টাজ করছেন তিনি। ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে পদাতিক, অগ্নিকোণ, চিরকুট- কাব্যগ্রন্হ । জেল খেটেছেন টানা দুবছর।
সেই কবি কাঁচরাপাড়ায় চলে এলেন ১৯৫৬ সালে। সাহিত্যিক জগদীশ মোদক-দের দ্বারা পরিচালিত ‘সৃজনী’ পত্রিকার এক সাহিত্য সভা ও প্রগতি পাঠাগারের এক আলোচনাসভায়। সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সতীশ নন্দী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওয়ার্কশপ রোডে। কবি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন “অশ্বমেধের ঘোড়া” খ্যাত সাহিত্যিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কবিতা, গল্পপাঠ তো হলই, এসময়ের সাহিত্য কেমন হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছিল।
আবার ১৯৬৭ সাল। ততক্ষণে তাঁর গায়ে ‘সংশোধনবাদী’র ছাপ্পা পড়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস তখন যুব ছাত্রদের দখলে। দুর্বার খাদ্য আন্দোলন, গ্রাম শহরে মিটিং মিছিল চলছে। সি পি আই- এর ছাত্র সংগঠন, বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন মিটিং ডাকল কাঁচরাপাড়া কবরস্থান ময়দানে। সেই মিটিংএ কবি হয়ে গেলেন রাজনৈতিক ভাষ্যকার, বক্তা। উদ্বুদ্ধ করলেন ছাত্র-যুবদের লড়াইয়ে অংশ নিতে। ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনে ১৬ ফেব্রুয়ারি,১৯৬৬ বসিরহাট মহকুমার স্বরূপনগরের নুরুল, ৪ মার্চ,১৯৬৬ কৃষ্ণনগরের আনন্দ হাইত প্রাণ দিয়েছিল। এই আন্দোলনে কাঁচরাপাড়ার বামপন্থী ছাত্র-যুবরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল। গ্রেপ্তার হয়েছিল দুই যুবক অশোক আর টুবলু।এই সেই অশোক মিত্র, শিক্ষক আন্দোলনে প্রথম ছাত্র শহিদ হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ইতিহাস রচনা করে।তাঁর স্মরণে কাঁচরাপাড়ায় একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
খাদ্য আন্দোলনে আনন্দ বাজার পত্রিকার শিরোনামে উঠে এসেছিল কাঁচরাপাড়ার নাম। শিরোনামটি ছিল : কাঁচরাপাড়া স্টেশন ভস্মীভূত। উল্লেখ্য এই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহতদের ৫০ জন শহিদের মধ্যে ২৮ জনই ছিল ছাত্র। এরপর স্বচ্ছন্দ গেরস্থালি পায়ে তিনি এলেন হালিসহর। সেটা জুলাই মাস ১৯৮৯। ‘পূর্বী’র সম্পাদক কল্পনা সেনের বাড়ি। হালিসহরের ঠাকুরপাড়ায় সেই গুপ্তদের ২০০ বছরের বেশি পুরনো ঐতিহ্যমন্ডিত বাড়ি যা এখন ‘সেন বাড়ি’ বলে জনে জনে জেনে গেছে। সকালে এসে সারা দুপুর কাটিয়ে বিকেলে চলে গেলেন তিনি নৈহাটীতে। সেখানে হালিসহর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুব্রত বাগচীর উদ্যোগে এক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন তিনি। কল্পনা বড় ভাগ্যবতী মেয়ে। ওর হাতে খেয়েছিলেন কবি ইলিশের ভাপা আর ভাত। বার দুয়েক কাঁচা লঙ্কাও চেয়ে নিয়েছিলেন। সেসব কথা এখন কল্পনার খুবই মনে পড়ে। কল্পনার ক্যাসেটে এখন স্মৃতি গন্ধবাহী কবি কন্ঠে কবির স্বরচিত কবিতার আবৃত্তি ধরা আছে। তাতে রয়েছে “যেতে যেতে” এবং “মিছিলের মুখ” কবিতাদুটি। পরবর্তীতে কল্পনার সঙ্গে যোগাযোগ করলে কল্পনা জানায় যে, সে তার মহামূল্যবান সম্পদ কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছে। বাড়ির পরিবর্তন হওয়ার কারণে এদিক ওদিক কোথাও হারিয়ে গিয়েছে সেই ক্যাসেট।
কাঁচরাপাড়া ইষ্টিশনের ওপারে গোকুলপুরের ‘নান্দনিক’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক দীপক কর বলল, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এখন তার চোখের তারায়। আসলে দীপক তার পুরনো পত্রিকা ‘বনলতা’র প্রতিনিধি হয়ে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিল কবির এক সাক্ষাৎকার নিতে। সেটা ছিল ৫ ডিসেম্বর ১৯৯৮। সেই সাক্ষাৎকারের ক্যাসেটই বাজালো দীপক ২৬ জুলাই তার বাড়িতে অনুষ্ঠিত কবির স্মরণসভায়।
কবির সঙ্গে এই প্রতিবেদকের শেষ দেখা কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে, ১৩ ই অক্টোবর ৯১, সকাল ১১ টা নাগাদ। সেদিন সি পি আই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ আনা হয়েছিল সি পি আই দপ্তরে। সেই অন্তিম যাত্রার আগে, পথে কবির সাথে এই প্রতিবেদকের কুশল বিনিময় হয়। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে সি পি আই নেতাকে। সেই শবযাত্রায় কবির পাশে হেঁটেছি। তখন কবি লিখে ফেলেছেন “যাচ্ছি” কবিতাখানি। ও মেঘ/ ও রোদ/ ও ছায়া/ যাচ্ছি/ ও বাংলা ভাষা /ও রবিঠাকুর/ নিকট ও দূর /ও
ক্ষুৎপিপাসা যাচ্ছি।
পৃথিবীতে ইনিই একমাত্র কবি যাঁর মৃতদেহ দখল নেবার জন্য এক রাজনৈতিক দল আগেভাগেই কবিকে ছিনতাই করে শবযাত্রার আয়োজন করে ইতিহাস রচনা করে।
দলদাস হতে দেখেছি।
হায়! কবিও ছিনতাই হয়ে যায়! বাংলাই লিখতে পারে এসব অধ্যায়!