সে এক পুরনো স্মৃতি! মদিবা ম্যান্ডেলা! মে আই বুই আফ্রিকা! ৩৩ বছর আগে ১৮ অক্টোবর ১৯৯০ নেলসন ম্যান্ডেলা কলকাতা সফরে এসেছিলেন।১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০। এই দিন নেলসন ম্যান্ডেলার জেল জীবনের ২৭ বছর পূর্ণ হয়।
আজ নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন। আন্তর্জাতিক মেন্ডেলা দিবস হিসাবে স্বীকৃত পরিচিত

সাচ্চা নিগ্রোর বাচ্চা
তমাল সাহা

আফ্রিকার জঙ্গল থেকে কালো চিতার মত ক্ষিপ্রতায় জ্বলজ্বল চোখে বেরিয়ে এসেছ তুমি
ভ্রুকুটি মেরে সূর্যকে একবার দেখে নিয়েছ।
সিংহের ঝুঁটি নাড়িয়ে তার হিংস্র নখরগুলোকে ভেঙে দিয়ে
পাইনের দৃঢ়তায় তুমি আমাদের সামনে—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!

কালো কফি আর কষাটে তামাকের কথা মনে পড়লেই ভেসে ওঠে
বনজ হাসি আবলুস কুঁদানো মুখ
একজন কালো নিগ্রোর শ্রম ও শক্তি।
আমাদের ধনুক বাঁকা শিরদাঁড়ার পাশে
জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো জ্বলতে জ্বলতে
পাটকিলে রঙের আকাশকে তুমি কেমন বর্ণময় করে তোলো—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!

পৃথিবীর ইতিহাস আর ইতিহাসের পৃথিবীতে
মানুষ ছাড়া কিছু নেই। আফ্রিকার মানচিত্র পাল্টে দিয়ে
তুমি ছুটে এসেছে সফরে ভারত মহাসাগর আর হিমালয়ের দেশে।
হিমবাহ নেমে আসার পিচ্ছিল নৈঃশব্দ্য এবং সামুদ্রিক ভৈরব জলোচ্ছ্বাস
মানুষের পদধ্বনির নীরবতাকে সরব করে তুলেছে।
তোমার জন্য তৈরি আছে দেশিয় আফ্রিকান লোকনৃত্য। ঝড়ো উদ্দাম জাজ সংগীতের মতো অনেক কথাই তুমি বলবে—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!

এই দেশে মার্কসের জন্ম মেটিয়াবুরুজে
কর্পোরেটরা এই উপকূল দখল নিতে চায়
বাঘের পেটে হরিণের বাচ্চা জন্ম নেয়।
কুড়িশো চাকার গাড়িতে কুবেরের কাঁধে ভর দিয়েও বঙ্গোপসাগরীয় কাছাধরা মানুষ হাওয়া খায়
লাল ফুল ফোটার প্রযুক্তির বাগানে।
এখানে কালো মেয়ের বিয়ে দিতে বাপের কোমরের খুঁট আলগা হয়
সাঁওতাল মেয়ের কালো পুরুষ্টু স্তনে মুখ রেখে
শাল মহুয়া জঙ্গলের মঞ্জরী কুড়িয়ে
বাবুরা শুয়ে থাকে বুনো জ্যোৎস্নায়।
পরদেশি বান্টু তুমি নিজ বাসভূমে
ক্রান্তি সংগীত গাইতে এসেছো পৃথিবীর দরজায়—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!

তোমার জন্য আমাদের কী বারফাট্টাই
তৈরি হচ্ছে পালক ও মুকুট
শহরের সর্বত্র রঙিন তোরণ
বিমানবন্দরের লাউঞ্জ পর্যন্ত পাতা হচ্ছে লাল কার্পেট
আজ রাতেই তোমার জন্য লেখা হবে সাতাশশো
কবিতা।
লাল গেরুয়া সাদা সবুজ পতাকা বর্ণাঢ্য অহংকারের দ্যুতি ছড়াবে তোমার অভ্যর্থনায়—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!

ধোবিখানার ছেলেটা
যে নোংরা কাপড়গুলোকে সবচেয়ে ফর্সা করে কাচছে
কচুরিপানার ডোবা জলে
লাইনের ধারে যে ছেলেটা ভুসো কালিমাখা হাঁড়িটায় গড়িয়ে যাওয়া ফ্যানের দিকে হা-পিত্যেশে তাকিয়ে আছে
যে ছেলেটা মাঠে নিড়েন দিতে গেছে বাবার সঙ্গে
মেয়েটা দুপুর রোদে
গামছায় বেঁধে নিয়ে গেছে ভাতের থালা
কারখানার গেটের কাছে বাবাকে দিতে
অথবা সেই মহিলা হাতে ধরা আছে তিন বছরের বালক
হাজিরা দিচ্ছে জেলখানার গরাদের ওপাশে দেখবে স্বামীর মুখ
আর সেই ছেলেটা যাকে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় লিখতে হবে এইসব
জীবনযাপনের টানাপোড়েন নিয়ে জীবনের লক্ষ্য—
এভাবে বেঁচে আছে আমার দেশের মানুষ
আমার দেশের এই ছবির কথা কি তুমি জানো?—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!

ট্রানস্কি উপত্যকায় বাতাসের প্রসব বেদনা
মরমি নদীর তীব্র আর্তনাদের ছলাৎ ছলাৎ
উমাতার কুনো গ্রামের পশুচারণ, চাষাভূষো,আবাদি ক্ষেত খামার
প্রিয় উইনির মুখ মোলায়েজের ফাঁসি
হীরে সোনা আর ইউরেনিয়ামের খনি থেকে উঠে আসছে কালো চামড়ার মানুষ
পিঠে চাবুকের দাগ
গাছের পাতা চুঁইয়ে নামছে রক্ত
মে আই বুই আফ্রিকা! মনে পড়ে তোমার নেলসন—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!

নেলসন!
কে তোমায় বলবে আমাদের দেশের গুলি খাওয়া শ্রমিকের কথা
পরিযায়ী মজুরের দল ঘুরে বেড়ায় এপাড়া থেকে ওপাড়া
কে বলবে তোমায় পশ্চিম আকাশ চেটে নিয়েছে মিছিলের রক্ত
কে বলবে তোমায় চটকল মজুরের আত্মহানের কাহিনী
কে বলবে তোমায়
খামারের মানুষ তপ্ত সীসে বুকে নিয়ে দেখেছে পুবের আকাশ
কে বলবে তোমায় যোনিছিন্ন আদিবাসী রমণী, দলিত নারীদের কথা
তুমি ভারতবর্ষের জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দিদের লড়াকু গাথাশুনতে পাচ্ছ কি?—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!

তুমি জীবনের কত বছর গরাদের ভেতর আটকে ছিলে!
এই ভারতীয় উপমহাদেশে এখন কত রাজনৈতিক বন্দীরা মাথা খুঁড়ে মরছে জেলখানার ভিতরে
কালা কানুন লাগু হয়েছে তাদের জীবনে
তুমি ভারতবর্ষ সফর করেছো
তুমি গণ সংবর্ধনা পেয়েছো।
আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সাতাশটি সাদা পায়রা
তোমার ওভারকোটে গুঁজে দেওয়া হয়েছে লাল গোলাপ
হাতে তুলে দেয়া হয়েছে মানপত্র ও ঝাউপাতা সজ্জিত স্তবক
সে কী রাজকীয় উন্মত্ত করতালি!
তোমার কি খুব ভালো লেগেছে নেলসন?—
সাচ্চা কালো নিগ্রোর বাচ্চা!