শিবরাম চক্রবর্তীর আজ প্রয়াণ দিবস

আমার গুরুদক্ষিণা
তমাল সাহা

মানুষ না বলে লোকটা বলেই শুরু করছি। লোকটা হকারি করত। ফুটপাতে রাতে ঘুমোতো। রাজনীতিও করত। কংগ্রেসের রাজনীতি। সে তো বিশাল জাতীয়তাবাদ। তবে লোকটা কোনোদিন বলেছিল, শ্রীকৃষ্ণের গীতার চেয়ে কার্ল মার্কস-এর গীতা বড়ো।

তারপর মেসের জীবন যাপন করত ।পৃথিবীর বিখ্যাত মেসওয়ালা। জীবনটা ছিল তার পান পূর্ণ। আমি বলতাম তিনি জীবন রস করেছিলেন পান। এই তো জীবন!

এ মানুষটা হয়ে গেল কলমচি। কবিতা দিয়ে জীবন শুরু। লিখল চুম্বন ও মানুষ নামে দুটি কাব্যগ্র।ন্থ। সেটা প্রকাশ হয়েছিল খুব সম্ভবত 1929 সালে।

লোকটা খুবই পাকা ছিল শুনেছি। কোন মেয়েকে সন্দেশ খাইয়েছিল। তারপর সন্দেশ খাওয়া মুখে সে মেয়েটি তাকে সন্দেশ খাইয়েছিল আর সেই মুখে চুমু খেয়েছিল সে। মেয়েটি ছিল পড়শি কিশোরী। এ চুমুতে অন্য মিষ্টি ছিল। তোমাদের পার্কে বা নদী তীরে বসে চুমু খাওয়ার যৌনতা নয়। চুমু নিয়ে এর চেয়ে ভালো কাহিনী আমি শুনিনি।

লোকটির বোধ করি বিপ্লবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। অনেক আগে পড়েছি খুব মনে নেই। বারীন ঘোষের সঙ্গে খুব সম্ভবত যোগাযোগ ছিল। লোকটা মুক্ত আরামে মুক্তারাম স্ট্রিটে থাকতো। এই গল্প সকলেই জানে। আর মুক্তারাম স্ট্রিটের মেসের দেয়ালের কারিগরি লেখাজোখা বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে।

লোকটা ভগবানের বিশ্বাস করত কিনা জানিনা। তবে লিখে ফেলল ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা। আবার ঘুরিয়ে লিখল, ভালোবাসা পৃথিবী ঈশ্বর। আর কি লিখল? মস্কো বনাম পন্ডিচেরি। নাটকও লিখল। হর্ষবর্ধন গোবর্ধন সে তো লম্বা কাহিনী।

তার নামের সঙ্গে জুড়ে গেল দুটো ঈশ্বর। শিব ও রাম। সে যাই হোক পাল্লায় পড়ে গেলাম আমি।
একবার দেখাও করলাম মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে তখন তো আমি বিপ্লবী নেশায় মত্ত। মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে তখন অনীকের দপ্তর ছিল।
যেহেতু সে বলল নেশা যখন করব, পয়সাই খরচ করব তো করব রাবড়ির নেশা। আমরা তো তখন ঋত্বিক ঘটক। বাংলা মদ আর চারমিনারের লোক!
তো মৃত্যুর আগে, এখন আর সেসব ভালো মনে পড়ে না– তখন আর তার দাদা বা ছোট ভাই তাকে বোধ করি শেষ রাবড়ি খাইয়েছিল।

সে বলেছিল, অত মন্দির মসজিদ বানাও কেন,কেন দেবালয়?
আরে ,তার চেয়ে বরঞ্চ বানাও শৌচালয়!
এটাই তো জন্মের পর মানুষের বিষয় আশয়‌।
এ দুটি অঙ্গ সব লিঙ্গ ধর্ম বর্ণ জাতের থাকে একদম নিচে‌। প্রক্ষালন ছাড়া কি মানুষ বাঁচে?
সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞান লোকটি মিলিয়ে দিয়েছিল জীবনের অপূর্ব আঁচে!

তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার জীবনের প্রথম লেখা কি?
সে ঝটপট উত্তর দিল, আমার প্রথম লেখা ছিল স্লেটে। সেটি হল বাংলা স্বরবর্ণ — অ।

জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনার জীবনী সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি বললেন আমার জন্মস্থান এই…
আমার বাবার নাম অমুক… আমি এই করেছিলাম…
তখন সাক্ষাৎকারী বলেন, আরে এসব জানতে চাইছি না।উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলুন।
তখন তিনি বললেন, তাহলে লিখুন আমার বাবার নাম নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ।
পলাশীর মাঠে রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন….

এই লোকটার কাছে আমি ডিম খাওয়ার উপযোগিতা শিখেছিলাম। কোন উপন্যাসে যেন নিজের স্ত্রীকে বলেছিলেন, আরে জামাইকে ডিম দিয়েছো? তোমার মাইয়ার না নতুন বিয়া হইছে!

লোকটা সব করেছেন, শুধু বিয়ে করেননি। বিয়ে করার ঝামেলা আছে, সেটা তিনি অনেক আগেই বুঝেছিলেন। আমি বুঝিনি।
তবে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া যে মধুর তা তিনি জানতেন।
এঁটো বাসন ধুতে দেখে স্ত্রী
যখন স্বামীকে বলে,তোমার কি ভীমরতি ধরেছে বাসন ধুচ্ছ? শিবরাম বলে, আরে আমি না ধুলে যে তুমি আবার রাগারাগি করবে, ঝগড়া করবে! স্ত্রী বলে, আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করবো না তো পরপুরুষের সঙ্গে করবো আর তুমি কার সঙ্গে ঝগড়া করবে, পরস্ত্রীর সঙ্গে?
তুমি দেখনি ঝগড়াঝাঁটির পর পাশের বাড়ির বউটাকে তার স্বামী খুব মারে ,কী ভালোবাসে! ঝগড়ার পর তুমি কোনদিনও আমাকে ওইরকম ভালবেসে মারোনি, গো!

লোকটা বলে,এই বয়সে আমি সম্পূর্ণ একা। আমার এখন কাজ শুধু পৃথিবীতে দেখা এবং শেখা। তোমরা দেখাও ত্রিশূল এবং তীর ধনুক। তার মানে শিব ও রাম। আমি এক দ্বৈত সত্তা। আমিই শিব, আমিই রাম–শিবরাম!
এতো বড়ো লেখক! একটা দেবতায় পোষায় কি
তার নাম! নাম তার—চক্রবর্তী শিবরাম।
লোকটা বলে, আমি জানি ব্যাকরণ, সন্ধি ও বিচ্ছেদ।
শিব্রাম চকরবরতী । দেখো তো আছে কোনো ভেদ?
আজ তাঁকে প্রণাম করি। জানু পেতে বসে আছি আজ রাতে তাঁর কাছে। ‌