আজ শিক্ষক দিবসঃ
কাঁচরাপাড়ার এক
স্বাধীনতা সংগ্রামী জেলখাটা মাস্টারমশাই

মাস্টারমশাই
তমাল সাহা

রোদ ম্লান হয়ে এলে রং গৈরিক হতে থাকে৷ তখন পেছনে ফেরার একটা বিষাদ মাখা সুখ লুকিয়ে থাকে অনুভবে। এসব সুখ, ফেলে আসা স্বরলিপি ভেসে ওঠে। স্বরলিপিতে লেখা থাকে কত জাগরণের কথা। স্কুল তো জীবনের আসল রঙ্গমঞ্চ। সেই রঙ্গমঞ্চের তুমি কুশীলব হলে মাস্টারমশাই নায়ক হয়ে ওঠে। তুমি তাকে চিনতে পারো অনেক পরে ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তোমার বোধবুদ্ধি অনেক পরিণত হলে। তোমার যাপিত জীবনে উত্তরণের পর্যায়ে তার ভূমিকা থেকে যায়। এটা তুমি অনেক পরে বোঝো। এটা অনেকটা ঠিক নদীর পারে পলল মাটি জমার মতো।

মাস্টারমশাইদের আমরা বিরক্ত করতুম যুগপৎ শ্রদ্ধাও করতুম। উপেনবাবুর ঘাড়ে দাদ ছিলো। তাই তাকে অগোচরে ডাকতুম “ঘাড় পচা”। ক্লাসে এসেই, ” এই লেখো” বলতেন বলে রামপ্রসাদ বাবুকে আমরা ডাকতুম “লিখ্যো”। রাসবিহারী বাবু পড়া না পারলে কোমরে চিমটি কেটে আমাদের নাচিয়ে তুলতো বলে তাকে বলতাম বৈজয়ন্তীমালা। সেই ছোট মাস্টারমশাই ধবধবে সাদা চুল, সাদা গোঁফ, সাদা শার্ট- ধুতি, সাদা কেডস পরনে তাঁকে ডাকতুম আমরা শ্বেতীবাবু। হিরন্ময় বাবুর কালো মোটা গোঁফ ছিল বলে আমরা ডাকতুম গুম্ফা। আর আমার বাবাকে আমার বন্ধুরা ডাকতো গামলা। কারণ আমাদের বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের গামলা গ্রামে। মাস্টারদের প্রতি এই বিরুদ্ধাচারণকে সামলে দিয়েছিলেন আমাদের মিশুকে এক প্রিয় মাস্টারমশাই। মাস্টারমশাইদের সঙ্গে বজ্জাতি!
তিনি আমার নাম রাখলেন টমাটো। আমার এক বন্ধুর নাম রাখলেন বেগুন। একজনের নাম রাখলেন চালিহা, একজনের নাম রাখলেন বলদেব।

তিনি ক্লাসে ঢুকেই বলতেন, আপনারা সব ভালো আছিস তো? পড়া তৈরি করে এনেছেন তো? এই যে বেগুন! আপনি বলো। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড কে বানাইছিল? এই যে টমাটো, বোর্ডের কাছে আসুন। ম্যাপ দেখে বলে দাও কলকাতা থেকে পঞ্জাবের রাস্তা কতদূর? তিনি খুব মজা করে আনন্দের সঙ্গে ক্লাস নিতেন। মিশুকে তো ছিলেন খুব। ক্লাস শেষে বলতেন, তবে নিশ্চয়ই কালুকা দেখা হইতাছে।

আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম একজন মাস্টার মশাই সক্রিয় কম্যুনিস্ট পার্টি করেন। কি করে বুঝলাম? সেটা ১৯৫৯ সাল। কমিউনিস্ট পার্টির ডাকা এক ছাত্র ধর্মঘট। বামপন্থী ছাত্ররা স্কুলে এসেছে পিকেটিং করতে। ছাত্র ধর্মঘট। তিনি চোখের ইশারায় আমাদের বললেন ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে। তখন কি ছাই এসব রাজনীতি বুঝতুম? পরে তো রাজনীতি আমার জীবন এলোমেলো করে দিল। তিনি নীরবে পার্টি করতেন। পরে জানতে পারি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। আরেকটু বড় হয়ে তাকে দেখলাম রাস্তায় ঝান্ডা হাতে পার্টির জন্য কৌটো নিয়ে পয়সা তুলতে। মাস্টারমশাই পার্টির জন্য পয়সা তুলছেন! উগ্রতা ছিল না তার চেহারায় চলনে বলনে। তার চেহারায় সেই ধুতি শার্টে কার মতো যে লাগতো! ওই পোষাকেই তো সন্ত্রাসবাদীরা ফাঁসিতে গিয়েছে, পিস্তল ধরেছে। তার ঢঙে, পোশাকে সেই ভাবটাই বজায় ছিল। পার্টি অফিসেও দেখেছি সেই না-বুঝ বেলায়। আমি কি অবুঝ ছিলান? এখন বুঝি তার প্রভাব পড়েছিল আমার উপর। জীবনটা আমার ভালোবাসা পাবার। এটা আমার আমৃত্যু ঋণ থেকে যাবে। তিনি আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। তিনি সিপিআইতে ছিলেন। পরে পার্টি ভাগ হলে তিনি সিপিআইএম- এর বদলে সিপিআইতেই থেকে যান। আরও পরে তিনি এআইসিপিতে ঢুকে যান।
তিনি এই জনপদের একজন কাউন্সিলরও হয়েছিলেন।

মাস্টারমশাইদের চরিত্র বিচিত্র। তিনি ইতিহাস পড়াতেন। তুমি সেরা ছাত্র হলেও তার হাতে কম নম্বর পাবে। একটি অমনোযোগী যাকে আমরা বাজে ছাত্র বলি সে তার হাতে বেশি নম্বর পাবেই। কোনও কৈফিয়ত সেখানে তোলা যাবে না।
“স্যার এই প্রশ্নের উত্তরটায় আমাকে ওর চেয়ে কম নম্বর দিলেন? ওর মতো বাজে ছেলে বেশি নম্বর পেয়ে গেলো! ও কি আমার মতো ভালো উত্তর লিখেছে?”
তিনি প্রথমে কটমট করে তাকালেন। তারপর বললেন,
“এদিকে এসো। খারাপ ছেলেরাই তো বেশি নম্বর পাবে।” আমি তাকিয়ে থাকি। তিনি বলে চলেন,
“ও উত্তর নিজের মতো করে বানিয়ে লিখেছে। একটা বিশেষ চেষ্টা করেছে। শ্রম দিয়েছে। তোরা ভালো ছাত্র। তোদের কাছে এটা জলভাত। ওদের একটা আলাদা প্রচেষ্টা শ্রম। ওদের একটা আলাদা মূল্য আছে। সে মূল্য তো আমাকে দিতেই হবে। সুতরাং ওরা বেশি নম্বরই পাবে।”
আমি হতবাক। চুপ। নীরব। উপরন্তু মাথা নীচু করে থাকি। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে জেল খেটে ছিলেন।

বড় তো হলুম। তখন তো স্যার আমার বন্ধু। তার বাড়ি ছিল আমার বাড়ির কাছেই নকড়ি মণ্ডল রোডে। পরে যদিও তিনি কল্যাণী রথতলা অঞ্চলে স্থায়ী মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করেছিলেন। একদিন তার বাড়িতে আড্ডা
“তো বলো, কি জানতে চাও?”
“ওই যে পিস্তল, আগ্নেয়াস্ত্র। আমার বরাবরই একটু আগুনের দিকে ঝোঁক। তখন নাইনে পড়ি। দাদা কুমুদানন্দের অনুসারী আমি। তিনি যুগান্তর দল করতেন। আমিও ভিড়ে গেলাম সেই দলে। পাঁচজনের একটি গ্রুপে আমিও ছিলাম। তখন আমাদের নেতা পূর্ণদাস, ললিত বর্মনের মতো সব আগুনখোর নেতা। পিস্তল ছোঁড়ারও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলুম।”
আমি বলি “কেন?”
“আরে আমরা অস্ত্রের জন্য, দল চালানোর জন্য তখন ডাকাতি করতুম। পরে ১৯৩৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হয়ে গেলুন। কুমিল্লা জেলায় গ্রেপ্তার হলুম। ‘দি কমিউনিস্ট’ নামের একটি কাগজ সাপ্লাইয়ের কাজ করতুম। সেটা ১৯৪০ সাল আবার গ্রেপ্তার হলুম ১৯৪৩ সালে। দু বছরের জেল। সঙ্গে ধীরেন ভৌমিক, মণি সেন, নগেন সরকাররা আমার সঙ্গে ঘানি টানলো। দু বছরে কখনও কুমিল্লার জেল, কখনও ত্রিপুরা , কখনও রাজশাহী জেল দেখে বেড়ালুম। হায় রে জীবন!
তারপর দেশ তো স্বাধীন হলো। এয়ারফোর্সে যোগ দিলুম। প্রশিক্ষণ পর্বেই বাদ। অভিযোগ কমিউনিস্টয়পার্টিম্যান। তারপর কলকাতায় এসে নৈহাটির গোপাল সুর সঙ্গে যোগাযোগ। সেখান থেকে কুঞ্জ বসু, অমূল্য উকিল। তারপর, এই তো স্বাধীন স্বদেশ!” বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

স্বাধীনতার রৌপ্য জয়ন্তীতে তাম্রপদক পেয়েছিলেন। তখন আমি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছি তাও ছ-সাত বছর হয়ে গিয়েছে। তখন আমিও রাজনীতির ময়দানে হাঁটছি। আমার চোখে তিনিই ছিলেন প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি আজীবন কমিউনিস্ট পার্টি করে গেছেন।

তিনি কে?
তিনি হলেন হোগলা পাতা হাই স্কুল অর্থাৎ কাঁচরাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা পর্বের শিক্ষক জয়ানন্দ ভট্টাচার্য।