সেই অসাধ্য সাধন করা গেঁয়ো ছেলেটি যে জন্মেছিল কাঁচরাপাড়ার অদূরে

তমাল সাহা

খুঁটে খাওয়া আমার স্বভাব। এই স্বভাবের অন্য একটা মজা আছে। হাতুড়ে শব্দটা মোটেই ভালো নয়। হাতুড়ে ডাক্তার অশোভনীয় কিন্তু হাতড়ে বেরানো শব্দের মধ্যে অজ্ঞতার ভাব আছে বলে সেটা আমার খুব ভালো লাগে।

কাঁচরাপাড়া থেকে খানিক দূরে। অনেকদূর বলা যাবে না। কারণ জানার আগ্রহ দূরত্বকে কমিয়ে দেয়। বৈপ্লবিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল একজন মানুষ। আমি তো ডুবুরি নই। সমুদ্রের তলদেশ থেকে খুঁজে আনবো মুক্তোগর্ভিণী ঝিনুক। সমুদ্রতটে বেড়াতে বেড়াতে ঢেউয়ে ভেসে এলো একটা জ্যান্ত ঝিনুক। সাগরের জলস্রোতে ভেসে এসেছিল। খোলস টেনে খুলে দেখি এক পুরুষ বালক। কাঁচরাপাড়া থেকে কাঁপা মোড় পেরিয়ে ওই যে মাঝিপাড়া গ্রাম সেখানে সে জন্মেছিল। ১৫ জুন ১৮৮৪। নাম তারকনাথ দাস।

তো সে কলকাতায় আর্য মিশন ইনস্টিটিউশনে পড়তো। এখান থেকে কি করে চলে গেল কলকাতা তা আমি জানিনা। ১৯০১ সালে এন্ট্রান্স পাশ করল। তারপরেই ভিড়ে গেল বিপ্লবী রাজনীতিতে। পুলিশি নজর তো পড়বেই। গ্ৰেপ্তার হবার আগেই চলে গেল দেশ ছেড়ে। ১৯০৫ সালে চলে গেল জাপান। তারপর ১৯০৬ সালে আমেরিকা। আমেরিকায় গিয়ে শুরু হলো আসলি কাম– জীবনের দ্বিতীয় পর্ব। শুধু গদর পার্টি নয় অন্যান্য বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ আর ‘ফ্রি হিন্দুস্থান’ পত্রিকার মাধ্যমে বৈপ্লবিক ভাবনা ও ভারতের মুক্তি সংগ্রামের প্রচার। ‌মেধাবী ছাত্র তো। ১৯১১ সালে এম এ পাশ করেই হয়ে গেল ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ফেলো। ১৯১৪-তে পেয়ে গেল মার্কিন নাগরিকত্ব।

মেধার সঙ্গে বিপ্লবী চেতনা জুড়ে গেলে সেই কাণ্ডকারখানা তো অন্যরকম হবেই। ১৯১৭ সালে আরেক মুক্তিপাগল শৈলেন ঘোষের সঙ্গে গঠন করে ফেলল আমেরিকাতেই ভারতের অস্থায়ী শাসন পরিষদ,ভাবা যায়! বিভিন্ন দেশে পাঠালো ভারতের মুক্তির জন্য সাহায্যের আবেদন।
এবার যাবে কোথায়? নিজের দেশের স্বাধীনতা চাও,গ্রেপ্তার হয়ে গেল। ২২ মাস জেলের ঘানি টানল।

মেধার স্বভাবই দৌড়ানো। এবার সে অর্জন করল পিএইচডি। সেটা ১৯২৪ সাল। কোত্থেকে? সেটা ওয়াশিংটন জর্জ টাউন ইউনিভার্সিটি থেকে। বিষয়-আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক আইন। ১৯২৫-১৯৩৪ সাল। দশবছর। বিয়ে করল এক মার্কিন নারীকে। সে জার্মানির মিউনিকে স্থাপন করল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট সংস্থা। উদ্দেশ্য, ভারতীয় ছাত্রদের বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদান। এই কারণেই পরবর্তীতে তারক দাস ফাউন্ডেশনের সূচনা হয়। ১৯৩৫ সালে আমেরিকা এবং ১৯৫০ সালে কলকাতায়ও এর একটি শাখা রেজিস্ট্রিকৃত হয়। ‌ নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলো সে। ১৯৫২ সালে ওয়াটমুল ফাউন্ডেশনের সদস্য এবং অধ্যাপক হিসেবে বিশ্ব পরিক্রমা করল। সেই নামজাদা পত্রিকা মডার্ন রিভিউ-য়ে প্রকাশিত হতো তার লেখা। পরে ‘ ফরেন পলিসি ইন ফার ইস্ট’ বক্তৃতামালার বিখ্যাত সংকলন বেরিয়ে গেল। সে লিখেছিল ‘ইন্ডিয়া ইন ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স’।
বাংলায় সে কি কিছুই লেখেনি? লিখেছিল ‘বিশ্ব রাজনীতির কথা’ নামক গ্রন্থটি। তারপর!

তারপর আর কি? নিউইয়র্ক থেকেই চলে গেল পরবাসে। সেটা ছিল ২২ ডিসেম্বর ১৯৫৮।

এই না হলে গেঁয়ো ছেলে! জন্মেছিল কাঁচরাপাড়ার অদূরে সে সময়ের এক অজ গাঁয়ে– মাঝিপাড়াতে।

তথ্যসূত্রঃ সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। সাহিত্য সংসদ।