অবতক খবর,২০ জুন,মলয় দে নদীয়া :-গরম টকবগে ফুটন্ত তেলে একের পর এক চলে যাচ্ছে হলুদ বেসনের গোলা। ডুবো তেলে ফুটতে ফুটতে বাদামি বর্ণের ফলে পড়ে তেল ছেঁকে নেমে পড়ছে তা ঝুড়িতে। কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে গোল করে ঘিরে থাকা অগুন্তি বেশ কয়েক জোড়া পলক না পড়া চোখ ,আর ঝুড়িতে নেমে পড়তেই কেউ এদিক থেকে বলছে আমায় কুড়ি টাকার দিন তো ওই দিক দিয়ে বলছে আমায় দশটা দিন।

মাঝখান থেকে দুটো নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে ঠেলাঠেলি । এভাবেই দিনের পর দিন শালপাতার ঠোঙায় করে সকলের হাতে হাতে চলে যাচ্ছে ফুলুরি। এভাবেই প্রতিদিন চার পাচশ ফুলরি নিয়মিত শেষ হয়ে যাচ্ছে কয়েক মিনিটের মধ্যেই।

নদীয়ার শান্তিপুরে এই ধরনের দৃশ্য দেখা যায় প্রায় ৭০-৮০ টি মিষ্টি এবং তেলেভাজার দোকানে এ দৃশ্য সকালে কিংবা বিকালে অথবা রাতে দেখা যায়। কোনো দোকানের বয়স দেড়শ তো কোনোটির বয়স ২০০ বছর। তবে এইসব দোকানগুলির পুরনো ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বাপ ঠাকুরদার ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও এই মূল্যবৃদ্ধির যুগে মাত্র 50 পয়সা প্রতি পিস হিসেবে ফুলরি বিক্রি করছেন তারা।

তবে বর্তমানে বিভিন্ন খরচ পারিশ্রমিক সময় এবং চাহিদার কথা মাথায় রেখে অনেকে আকারে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে এক টাকা এবং দুই টাকার মাপেও করে থাকেন। তবে ক্রেতাদের একাংশের মতামত এতে ভেতরের অংশে খুব বেশি স্বাদ হয় না বরং সে তুলনায় ছোটো ফুলুরিই ভালো। তবে বেশির ভাগ দোকানদারদের ক্ষেত্রেই ১ কেজি বেসনে কতটুকু তেল লাগে কিংবা কতগুলো ফুলুরি হয় এসব জটিল হিসাব নিকাশ তারা রাখেন না কেউ জানেন সামান্য লাভ হয় কেউ জানেন লাভ নাইবা হলো অন্যান্য মিষ্টান্ন কি বা খাদ্য উপকরণ থেকে লাভ চলে আসে ফুলুরি থাক পরিষেবার মধ্যেই, ক্রেতাদের আকর্ষণের বিষয়।

তবে শান্তিপুর বড়বাজার এলাকায় পরপর দুটি দোকান ভারত মাতা এলাকায় দুটি দোকান সহ সুত্রাগড় এবং অন্যান্য ইতস্তত দুই একটি দোকানে আজও মেলে এই ৫০ পয়সার ফুলুরি।

জ্বালানি খরচ ভোজ্য তেল, বেসনের দাম যতই বাড়ুক শান্তিপুরের এই ঐতিহ্য ও পরম্পরা কে ধরে রাখতেই লাভের চিন্তা মাথায় না রেখে আজও রীতিমতো ন্যূনতম দামে তারা এই ফুলুরি আজও দিনের পর দিন একইভাবে দিয়ে চলেছেন বেশ কয়েকটি দোকান।

নদীয়ার শান্তিপুরের দোকানের বর্তমান মালিকেরা জানাচ্ছেন শুরুর দিকে তাও আজ থেকে প্রায় শতাধিক বছর আগে ফুলরি বিক্রি হতো দশ পয়সায় দশটা। তার পরবর্তীকালে প্রতি পিস ফুলুরি বিক্রি হত দু পয়সা করে। আর বর্তমান প্রজন্ম সেই ফুলুরি বিক্রি করছে পিস প্রতি ৫০ পয়সা করে। যা আজকের দ্রব্যমূল্যের বাজারে দাঁড়িয়ে এক কথায় অসম্ভব।

তবে দোকানের মালিকেরা জানাচ্ছেন মূল্যবৃদ্ধি যাই হয়ে যাক না কেন দাম চেপে ঐতিহ্য বজায় রাখাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। যাতে প্রতি তুই বাঙালির ঘরে ঘরে সন্ধ্যেবেলা পৌঁছে যেতে পারে চা মুড়ির সঙ্গে এই ফুলুরি।

তবে ফুলের পাশাপাশি সিঙ্গারা নিমকি ইত্যাদিও সেই সমস্ত দোকানে যথেষ্ট পরিমাণেই বিক্রি হয়। সেই সমস্ত তেলেভাজা থেকে লাভ হলেও ৫০ পয়সায় ফুলরি বিক্রি করে নিজেদের ঐতিহ্য ও পরম্পরার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন সেই সমস্ত শতাধিক বছর পুরনো দোকানগুলি।

শান্তিপুরের বড়বাজার অঞ্চলে রাত আটটার পর দুটি দোকানের মধ্যে প্রতিদিন চলে ফুলরির লড়াই। তবে এ লড়াই নিছকই ক্রেতাদের ভিড়ের লড়াই। পাশাপাশি দুটি দোকান হলেও আজ পর্যন্ত বিক্রি বাট্টা নিয়ে কোনদিনও তাদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা লাগেনি বলেই জানান তারা। তারা জানাচ্ছেন, প্রত্যেকের হাতের রয়েছে আলাদা আলাদা নিপুণতা, ও রান্নার স্বাদ তার ওপর ভিত্তি করেই খরিদ্দাররা আসেন।

তবে যদিও এই সমস্ত ফুলরি সারাদিন পাওয়া যায় না, শুধুমাত্র রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়তেই পাবেন এই স্বল্প মূল্যের সুস্বাদু ফুলুরি।

ক্রেতারা জানাচ্ছেন, রমজানের মাসে ইফতার পাতে হোক, কিংবা রাতে কিংবা সকালে পান্তা ভাতে প্রয়োজন পড়ে একটি তেলেভাজা। আর সেই তেলেভাজা হিসেবে সকলের প্রথম পছন্দ শান্তিপুরের এই ফুলরি। অতিথি আপ্যায়নেও মন্দ নয়! শনি সোম শুক্র কিংবা বৃহস্পতিবার বেচাকেনা বারে সম্পূর্ণভাবে নিরামিষ হওয়ার কারণে এমনটাই মতামত দোকানদারদের।

তবে অন্যান্য জেলায় অতটা প্রচলিত নয় লঙ্কা কুচি দিয়ে এই বেসনের গোলা ভাজা। নদীয়া জেলাতেই এই ফুলরি খাওয়ার প্রচলন তুলনামূলকভাবে বেশি বলেই জানাচ্ছেন ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ই। যার মধ্যে অন্যতম এই শান্তিপুর।