এই ঘনায়মান রাত্রিতে আপনিও পড়ে মানসিক শান্তি পেতে পারেন।
গাঙ্গেয় প্রদেশেএই অমারাত্রির কালে রাষ্ট্রীয় জীবনে যখন নৈতিক অধঃপতন নেমে এসেছে দুর্নীতির কারখানায় পরিণত হয়েছে এই সমতলভূমি তখন তোমার কথা মনে করে একটু স্বস্তি পাই। তুমি কি এই বাংলা চেয়েছিলে? আজ বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্মদিন।
একটি বিশ্বাসঘাতক হত্যার বিবরণ
তমাল সাহা
বিপ্লব! বিপ্লব! বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
এই স্লোগান তো সকলেই শুনেছে। বিপ্লবী কত প্রকার হতে পারে,তার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু। অত্যাচারী রাষ্ট্রীয় শাসককে হত্যা করতে কি চাই? সে তো পিস্তল। আর তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ রেখে যায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
মেদিনীপুর লেখে একের পর এক ইতিহাস। বোমা বানাতে, বোমা ছুড়তে মেদিনীপুর বাড়ায় হাত। বোমা নিক্ষেপেও হাতে খড়ি লাগে। সেই কিংসফোর্ডের কথা মনে পড়ে? বোমা বিস্ফোরণে তাকে হত্যা করতে ক্ষুদিরামকে হাতে খড়ি দিয়েছিল কে? শিষ্য ক্ষুদিরামকে সকলেই চেনে, আর তার গুরুর কথা কে মনে রাখে?
মনীষী রাজনারায়ণ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ পিস্তলবাজ,ভাবা যায়! সম্পর্কে অরবিন্দ ঘোষের মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ। যদিও বয়সে ১০ বছরের ছোট। সে কিনা বোমারু, বারুদে হাত পাকায়? এসব ছেলের আসলে বারুদ লগ্নে জন্ম। বর্ষাকাল, ৩০ জুলাই জন্মালেও বারুদ তাতানো ছিল সত্যেন্দ্রনাথের বুকের ভেতর। মেদিনীপুরের কালেক্টারের কাজ তাঁর পোষায় নাকি? সে তো বারুদ-বালক তৈরীর কাজ চায়। ১৯০৫ সাল,বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন গড়ে তোলে ‘ছাত্র ভাণ্ডার’। সাইনবোর্ড রাখো সামনে অন্তরালে চালাও বৈপ্লবিক কাজ। বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোকে দাও মদত। সেই যে ‘সোনার বাংলা’ বিপ্লবী অক্ষরে সাজানো হাতে গরম ইস্তেহার কে বিলি করেছিল? ক্ষুদিরাম। কে মদত দিয়েছিল? সত্যেন্দ্রনাথ বসু। অস্ত্র ছাড়া কি জোটে অন্নবস্ত্র? সত্যেন্দ্রনাথের কাছে ছিল লাইসেন্সবিহীন বন্দুক। দেশকে করব স্বাধীন, তুমি রাষ্ট্র চালাবে শোষণ। আর আমার কাছে অস্ত্র থাকলেই সেটা নাকি অপরাধ! দুমাস জেলের ঘানি টানো, সঙ্গে দাও জেলখানার শ্রম। গ্রেপ্তার হয়ে গিয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ।
মুরারিপুকুর বাগান বাড়ি। এ তো বারুদ ঘর! কি নেই সেখানে অস্ত্র, গোলা, বোমা বারুদ, ডিটোনেটর! কে কে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল? অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ উল্লাসকর দত্ত, সে নিজে আরো কত, প্রায় তিরিশ জন।
সে সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছিল নরেন গোঁসাই। সে হয়ে গেল বিশ্বাসঘাতক, রাজসাক্ষী। এ তো সব গোপন কথা, অন্যান্য বিপ্লবীদের নাম ফাঁস করে দেবে! সত্যেন্দ্রনাথ বলে উঠল, শুধু চাই একটি রিভলবার। আমার লক্ষ্য নরেন গোঁসাই, তাকে করতেই হবে খতম। এই না হলে বঙ্গজননীর গর্ভজাতসন্তান! সে এক বিপ্লবী কৌশল। সত্যেন্দ্রনাথ নরেনকে ডেকে পাঠালো।
— শোন নরেন! আমিও রাজসাক্ষী হতে চাই। কি কি করতে হবে, বল? নরেন তো খুশি। এদিকে সত্যেন্দ্রকে পিস্তল পৌঁছে দিল সেই কানাইলাল দত্ত।
শোনো এবার বিশ্বাসঘাতক হত্যার বিবরণ।
১লা সেপ্টেম্বর অসুস্থতার ভান করে সত্যেন্দ্র তখন ভর্তি হাসপাতালে। নরেন গোঁসাই এলো সঙ্গে তার দেহরক্ষী হিগিন্স। নরেন হিগিন্সকে বললো, বাইরে অপেক্ষা করো। আমি একটু কথা বলে আসছি। এদিকে কানাইলাল দত্ত বারান্দায় দাঁতন করছে। সেও রেডি, সঙ্গে লুকানো পিস্তল। আলোচনা শুরু হতেই চাদরের তলা থেকে পিস্তল বার করে গুলি চালালো সত্যেন। নরেনের উরুতে লাগলো গুলি। আহত বিশ্বাসঘাতক পালাতে উদ্যত। এবার কানাইলাল দ্রুত গুলি চালালো পলায়নপর নরেনের দিকে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট। লাগল পাঁচিলের গায়ে। এবার গুলির শব্দ শুনে হিগিন্স বাধা দিতে এলে সত্যেন্দ্র গুলি ছুড়লো হিগিন্সের দিকে। হিগিন্সের কব্জিতে লাগলো গুলি। আহত হিগিন্স পড়ে রইল।
নরেন ছুটছে, সত্যেন্দ্রও ছুটছে। নরেন হাসপাতালের গেটের বাইরে চলে গেছে। দারোয়ান গেটের দরজা বন্ধ করে দিলে সত্যেন্দ্র সারোয়ানের বুকে ঠেকালো পিস্তল। ভীত দারোয়ান কাঁপছে। খুলে দিল দরোজা। নরেন সত্যেন্দ্র মুখোমুখি। ছুটে এলো জেলার এবং লিন্টন নামে এক কয়েদি। বাধা দিতে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। সত্যেন্দ্রনাথ তখন তো বেপরোয়া।এদিকে কানাইলাল রণক্ষেত্রে উপস্থিত। কানাইলাল এবার ছুড়লো গুলি। সেই গুলি লিন্টনের কান ছুঁয়ে নরেনকে বিদ্ধ করলো। সত্যেন্দ্রনাথও চালালো গুলি। নরেন টাল খেয়ে পড়ে গেল সংলগ্ন এক নর্দমার মধ্যে। কানাইলাল চালালো গুলি। বিশ্বাসঘাতক খতম।
সত্যেন্দ্রনাথ ও কানাইলাল মিলে মোট নটি গুলি ছুড়েছিল। চারটি গুলি বিদ্ধ হয়েছিল নরেনের শরীরে। ডিসপেন্সারির দেওয়ালে দুটি পাঁচিলে একটি,হিগিন্সের দেহে একটি এবং শেষ গুলিটি আশ্রয় নিয়েছিল নর্দমায় পড়ে যাওয়া নরেনের বুকে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত গ্রেপ্তার হয়ে গেল।
ফাঁসির আগে সত্যেন্দ্রনাথ বলে, মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি যদি মা এখানে এসে না কাঁদেন। কানাইলাল দত্ত সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী বলেন, জেলখানার খাঁচায় দেখে এলাম একটা সিংহ পায়চারি করছে।
২২ নভেম্বর ১৯০৮ এলো সেই মহান দিন।সত্যেন্দ্রনাথের ফাঁসি হলো।জেল গেটের বাইরে বিশাল জনতার সমাবেশ। একজন শহীদের ফাঁসিতে ভয়ে কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। এতই ভয়, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মৃতদেহ আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি।
জেলখানার বিশাল উঁচু পাঁচিলের ভিতর তাকে দাহ করা হয়েছিল। মৃতদেহ শহিদের দেহ হয়ে উঠলে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে ভূপৃষ্ঠ থেকে লাভার উদগীরণ ঘটে!
তোমার আমার এই স্বাধীন দেশ! এখনো জন্মভূমি কেঁদে চলে। হায়! সত্যেন্দ্রনাথ,হায়! কানাইলাল…..