অবতক খবর,৯ অক্টোবর: দেবীপক্ষের শুরু হয়ে গেছে। জিন্স প্যান্ট থেকে রঙিন ফ্রক কিংবা হাই হিল থেকে মোটা গামবুট সব শব্দ যেন মিলেমিশে একা কার।বাঙালির আকাশে বাতাসে শরতের পেজা তুলোর ঘনঘটা আছে বটে, তার ওপর যেন মাঝে মাঝে অঘটন ঘটিয়ে ধেয়ে আসছে কালো কালো মেঘ।
বৈচিত্র্যময় সময়ে চারিদিকে দুর্যোগে হাতছানি। আর হবেই না কেন এবারের ২০২৪ এ দেবী দুর্গার আগমন হচ্ছে দোলায় যার ফল মড়ক এবং মহামারীর প্রতীক। এবং দেবীর গমন হচ্ছে ঘটকে।
ঘোটক বা ঘোরার গমনে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এলোমেলো অবস্থা অবশ্যম্ভাবী। দেবীর ঘোটকে গমন হলে যুদ্ধবিগ্রহ অশান্তি বিপ্লব ইত্যাদি সংকেত থাকে। তার মধ্যে দিয়ে প্রেমময় বাঙালি আপন করে নিতে চাইছে এই দুর্গা উৎসব কে।
আজ মহাষষ্ঠী। আচার মতে দেবী দুর্গা প্রতিমা অর্থাৎ মূর্তিকে প্যান্ডেলের স্থাপন করার পর বোধন নামে একটি পবিত্র আচারের সময় মহাষষ্ঠীতে প্রথম দেবীর মুখ দেখা যায়। ভারতে মহাষষ্ঠী হলো প্রেমের দিন। এই দিনে লাল রঙের বস্ত্র ধারণ করাটা পবিত্র হিসেবে ধরা হয়। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে আজকের দিনেই তো প্রেমের ঔরস জাগানোর দিন।
গ্রাম্য এবং বারোয়ারি পুজোতে মহিলারা মঞ্চ সাজাতে এবং দেবীকে তার পিতার বাড়িতে স্বাগত জানানোর পথিক হিসেবে মহাষষ্ঠীতে “দুর্গা কলস” স্থাপন করেন আর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। জমিদার বাড়িতে অতীতের দিনে যাত্রা কিংবা থিয়েটার হওয়ার মঞ্চ স্থাপন করা হতো। এই মঞ্চটি বাধা হতো একেবারে দুর্গামূর্তির পাদদেশে।
আসলে দেবী দুর্গার যুদ্ধের বিবরণের সঙ্গে কথিত আছে এক অতি পরিচিত ইতিহাস। হিন্দুদের বিশ্বাস, দেবী দুর্গা মহালয়ার দিনে মহিষাসুরকে বধ করার সংকল্প গ্রহণ করেন এবং সেদিনকেই তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন মহিষাসুরের সাথে। দশম দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে পরাজিত করেন। এই নয় দিন নয় রাত ধরে চলা যুদ্ধের সময়টিকে সারা ভারতবর্ষের মানুষ “নবরাত্রি” হিসাবে পূজিত করেন।
মহা ষষ্ঠী হল নবরাত্রির ষষ্ঠ দিন এবং দেবী দুর্গার আরেক অবতার দেবি কাত্যায়নী, ভারতবর্ষে জাঁকজমক এর সাথে বিভিন্ন জায়গায় পূজিত হন। অর্থাৎ এই মহাষষ্ঠী দিনে।দেবী কাত্যায়নী নব দুর্গা নামে প্রচলিত। ভদ্রকালী বা চন্ডীর মত যুদ্ধদেবী হিসাবে পূজিত।দেবী কাত্যায়নী গাত্রবর্ণ এবং লাল। এই লাল রং সাহস এবং বীরত্বের প্রতীক এবং আজকের দিনে এই লাল রংয়ের পরিধান অত্যন্ত শুভ। অবশ্য আরেকটি মত অনুযায়ী কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে ঋষি কাত্যায়ন প্রথম দেবী পার্বতীর পূজা করেন। তাই তিনি দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হন। দেবী কাত্যায়নী এর সম্বন্ধে বলতে গেলে অনেক কথাই চলে আসে। দেবী কাত্যায়নী ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত রাজ্যে পূজিত হন । এবং প্রত্যেকটি মন্দিরের এক একটি ভিন্ন নাম আছে।সিংহ অস্বারোহণ হিসেবে ১৪০০, ১৫০০ শতকে বিভিন্ন পটচিত্রে চিত্রিত হয়ে আছেন দেবী। মজার ব্যাপার হলো বিভিন্ন রাজ্যে দেবী চার থেকে দশটি, এমনকি কয়েক জায়গায় ১৮ টি সংখ্যক হাত দেবীর শরীরে চিত্রিত হয়ে আছে।
এবার আসি এই মহাষষ্ঠীর কথায়।আমাদের সনাতন ধর্মে আক্ষরিক অর্থে যোগসূত্র ছাড়া আচার ধর্ম করা হয় না। তাই মহাষষ্ঠীর পূজা বারবার এই যোগসূত্রের প্রমাণ দেয়। দুর্গাপুজোর শুরুটা হয় মহাষষ্ঠীর ভোরে। সূর্যোদয়ের ঠিক পরেই মায়ের পুজো সঠিকভাবে পালন করার এক সংকল্প নেয়া হয়। যাকে বলা হয় “কল্পারম্ভ”। আসলে কল্পারম্ভ দেবীর বোধনের সাথে জড়িত ।এই “বোধন” কথার অর্থ জাগরিত করা। কথিত আছে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করার আগে, অসময়ে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। আসলে দেবীর পূজিত সময় হলো চৈত্র মাস এ। অপ্রতুল পরিস্থিতিতে, শ্রী রামচন্দ্রের দেবীর দুর্গার পূজা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। অসময়ে দেবীর পূজার আগে শ্রী রাম, মা দুর্গাকে জাগ্রত করেছিলেন। একেই অকালবোধন বলে। এখন প্রশ্ন হল, কেন এই সময়টিকে অসময় বলা হয়? আসলে শরতের এই সময় সূর্যের দক্ষিণায়ন চলে। দেবতারা এই সময় বিশ্রামে এ যান বলে মনে করা হয়।
তাই বোধনের মাধ্যমে দেবীকে নিদ্রা থেকে জাগরিত করতে হয়। বোধনের সময় বেলগাছের গোড়ায় একটি জলভর্তি তামার পাত্র স্থাপন করা হয় অথবা বেল গাছের একটি ডাল পাত্রে রাখা হয়। এই জল ভরতি তামার পাত্র রাখা কে “কল্পারম্ভ” বলা হয়। তারপর মাকে জাগানোর জন্য প্রার্থনা করা।
মাকে জাগানো তো হল কিন্তু আবাহন করা হবে কি করে? তাই এই সময় মায়ের তৃতীয় আচার অনুষ্ঠানটি করা হয় যার নাম হল “অধিবাস”। অধিবাসের রীতিনীতি খুব সুন্দর। যেই বেল গাছে মায়ের বোধন হয়েছে। সেই বেল গাছকে পুজো করার পর ২৬টি মাঙ্গলিক দ্রব্য দেবীর মূর্তিতে স্পর্শ করানো হয়। এবং যেখানে পূজো করা হয় সেই বেদি কিংবা জায়গার চারপাশে একটি লাল রংয়ের সুতো বাঁধা হয়। এই অধিবাসের মাধ্যমে, যাতে কোন রকম শুভ শক্তি পুজোয় বাধা না দিতে পারে, তার জন্যই আচার অনুষ্ঠানটি করা হয়। এরপর সর্বশেষ অনুষ্ঠানটির নাম “আমন্ত্রণ”। এই আচারের মাধ্যমে দেবীকে পরের দিন সপ্তমী পূজা গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। মাকে পাঁচটি দ্রব্য দিয়ে পূজা করা হয়। এবং আরতি করা হয়। এত সবের মধ্যে মাকে বিশ্রাম দেয়া হয়। আর হবে নাই বা কেন এত দূর থেকে মর্তে অর্থাৎ আজকের দিনেই তো শাস্ত্রমতেই বাড়ি পৌঁছান উমা। জেটল্যাগ বলে তো একটা কথা আছে নাকি।
এদিকে শৈশব থেকে কৈশোর পুজো উদযাপনের রিহার্সেলগুলো কিন্তু করা শেষ হয়ে গেছে। এবার ফাইনাল শট। পুরো এক বছরের অপেক্ষা কার্যত আজকে মিটলো।সদ্য কৈশোর পেরিয়ে মিষ্টি যৌবনগুলো আজ ধরা দিতে চায় কোন এক রাগ প্রণয়ের বন্ধনে। আর শৈশব? সেটা তারা স্মৃতির পৃষ্ঠায় একে একে বেঁধে রাখে তার ভবিষ্যতের বেঁচে রাখার তাগিদ কে। আর প্রবীণ? মণ্ডপের কোনায় দাঁড়িয়ে প্রথমে খুলে ফেলে তার চশমা টি। বারিধারা সিক্ত দুটি চোখে, উমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “মা তুই এসেছিস”। উলুর বোলে, ঢাকের তালে সব মিলেমিশে একাকার। উথাল পাথাল হয়ে যায় হৃদয়। হবে নাই বা কেন? মা এসেছে যে।