অবতক, ১৩ মার্চঃ সত্যজিৎ রায় আন্তর্জাতিক মানুষ। তাঁর জ্ঞান বৈদগ্ধ্য পরিমাপ করার যোগ্য মানুষ আমি নই। তাঁর প্রমা ও সৃজনশীলতাকে অনেকে রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য মনে করেন। তিনি বহু পুরস্কৃত এবং প্রশংসিত তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তিনি আমাদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে আছেন এটাই বড় কথা।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন বাস্তবতার সঙ্গে শৈল্পিকবোধ কীভাবে মেশাতে হয় এবং তা দেখিয়েছেন হৃদয়ে উৎসারিত সহজ সরল কারিগরিতে। মাথা চুলকে বোঝার মতো চলচ্চিত্র তিনি নির্মাণ করেন নি। এবং তাঁর লিখনশৈলীতেও অন্য ধারা বহমান। অনেক লেখায় কৈশোর সুলভ মনোবৃত্তি থাকলেও তা প্রবীণের স্পর্ধাকে অতিক্রম করে যায়।
বয়স নির্বিশেষে তাঁর লেখা পাঠ করা যায় এবং পঠন পাঠনের মাধ্যমে অন্য সুখবোধ জাগ্রত হয়। কিছু পেলাম বলে প্রতিনিয়ত মনে হয়।
অনেকে কমিউনিস্ট পার্টি বা বামপন্থী ছাঁচে ফেলে মানুষকে বিচার করেন। তিনি কোন ধাঁচের তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তিনি উৎপল দত্তের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়েন। তিনি বাংলার প্রকৃতির নৈসর্গিকতার সঙ্গে একাত্ম করে দারিদ্র্যের জীবন সংগ্রাম দেখান।
তিনি কখনও ‘সীমাবদ্ধ’ তো কখনও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হয়ে যান। তিনি কখনও ‘ঘরে- বাইরে’ তো কখনও ‘সদ্গতি’ হয়ে যান। তিনি কখনও হাল্লার রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করেন তো দড়ি ধরে টান মেরে রাজাকে খানখান করার কথা বলেন।
তিনি কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কর্মীকে নিয়ে গল্প লেখেন। তখন তিনি আঞ্চলিকভাবে আমাদের কাছের হয়ে যান। ইতিমধ্যে তিনি আরও অনেক নৈকট্যে এসে গেছেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে এই নিকটবর্তী কল্যাণীতে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নামে ফেলোশিপ ঘোষণা করেছে। ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি দুদিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আয়োজক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। আলোচনার শীর্ষক ছিল ‘সত্যজিৎ একাই একশো’। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেই প্রখ্যাত অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়, সমালোচক প্রাবন্ধিক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়,অভিনেতা বরুণ চন্দ, লেখক প্রসাদরঞ্জন রায় ও লেখক নবকুমার বসুর মতো বুধজন।
আলোচনার শেষ দিন অর্থাৎ দ্বিতীয় দিন উপাচার্য অধ্যাপক শঙ্কর কুৃমার ঘোষ বলেন, আজকের দিনটি অর্থাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারি দিনটি তাঁর ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, বছর জুড়ে সত্যজিৎ রায়ের সামগ্রিকতা নিয়ে কুইজ, বিতর্ক, সিনেমা, প্রদর্শনী তো বটেই বিদগ্ধ আলোচনারও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
সত্যজিতকে নিয়ে প্রজন্মরা যে সৌকর্যমূলক এবং গবেষণার কাজ এম.ফিল বা পিএইচ ডি করবেন তাদের আমরা ফেলোশিপ দিয়ে সম্মানিত করবো।
আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে এমন উপলব্ধি এবং অনুভব লক্ষ্য করা যায়নি।
স্মরণীয় ও প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য রাখেন প্রসাদরঞ্জন রায়। প্রসাদরঞ্জন রায় সত্যজিৎ রায়ের খুল্লতাত ভ্রাতা। তিনি বলেন, সত্যজিৎ রায়ের সামগ্রিক সত্তা, চিন্তন ও সৃজন নিয়ে এমন একটি ফেলোশিপ প্রবর্তনের ভাবনা অবশ্যই অভিনব এবং ঐতিহাসিক।
মাধবী মুখোপাধ্যায় তো সত্যজিৎ রায়কে ঈশ্বরপ্রতীম বলে উল্লেখ করেন। কারণ সৃজনের ঐশ্বর্যে তিনি পরিপূর্ণ ছিলেন।
লেখক নবকুমার বসু বলেন, সত্যজিৎ রায়ের লিখনশৈলীর মূল বিষয়ই হলো সাধারণ জনের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তবে তাঁর লেখায় জটিলাতার কোনো কারুকাজ নেই।
বরুণ চন্দ বলেন, তিনি তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে মানুষের উত্তরণ ঘটিয়েছেন। সন্দীপ রায় জানান, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে এর চেয়ে ভালো কাজ, মানুষের মধ্যে তাঁকে বিস্তৃত করে দেবার কাজ— এছাড়া ভালো কাজ আর কি হতে পারে!
সত্যজিৎ মানে সত্যকে জয় করেন যিনি। সাধারণ মানুষ তো সহজ, সরল স্বাভাবিক সুন্দর। সুতরাং সৃজন শৈলীতে সহজ সুন্দরের অবস্থান অনিবার্য। সেটাই জনস্বার্থে আজীবন প্রদর্শিত করেছেন শিল্পী সত্যজিৎ রায়।
সত্যজিৎ রায় কল্যাণীর শিক্ষা ও জনজীবনে এইভাবে জুড়ে গেলেন– এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হয়ে রইল এই অঞ্চলের নাগরিক জীবনে।