বিনয় ভরদ্বাজ , অবতক খবর, 23 শে মে :: আজ 23 শে মে । আজকের দিনটি পশ্চিমবঙ্গের জন্য ঐতিহাসিক দিন। কারণ এই বাংলার লোকসভার 42টি সিটের মধ্যে 18টি সিটে জয়ী ঘোষিত হয়েছিল বিজেপি।
রাজনৈতিক পণ্ডিতদের সমস্ত হিসেব-নিকেশ অংক ,গণনা সবকিছুকে ভুল প্রমাণিত করে বাংলার বুকে গেরুয়া শিবিরে সবচেয়ে বড় উত্থান ঘটেছিল আজকের দিনেই।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার সংগঠন নিয়ে যে অহংকার করতেন তা আজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়েছিল । শুধু তাই নয় মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট,পুলিশ রিপোর্ট তার গুড বুকে থাকা সমস্ত নেতাদের রিপোর্ট সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই সেসব ধরা পড়েছিল আজকের দিনেই।
হ্যাঁ নির্বাচনের সময় থেকে নিয়ে এক্সিট পোল ,বুথ ফেরত সমীক্ষা, মুখ্যমন্ত্রী সাংগঠনিক কর্মকর্তাদের দলের জয় নিয়ে তৈরি করা বুথ ফেরত রিপোর্ট পুলিশ রিপোর্ট গোয়েন্দা রিপোর্ট সবটাই যে বাস্তবতা থেকে অনেকটা দূরে ছিল সেটা একবারে কাঁচের মত পরিষ্কার হয়ে গেছিল আজকের দিনটিতে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদের উপর ভরসা করেন তারা যে বাংলার সাধারণ মানুষ থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন সেটাও আজকের দিনেই প্রমান পাওয়া গেছিল। মুখ্যমন্ত্রীর আমলারা, চামচারা যে তাকে খুশি করতে ব্যস্ত, তা আজ তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। আর দলের নিচু তলা থেকে উপর তলা পর্যন্ত নেতাদের যে মানুষ থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছেন তাও বোঝা গেছিল আজকের দিনটা থেকেই।
গ্রামে গঞ্জে তৃণমূল ভেতর ভেতর একেবারে ফাঁকা হয়ে পড়েছে তা বুঝিয়ে দিয়েছে আজ এই দিনটি অর্থাৎ 23 শে মে 2019। তবে শেষ হাসি হেসেছিলেন বিজেপিতে নবাগত দক্ষ কূটনীতিক বিশেষজ্ঞ মুকুল রায়। তিনি বলেছিলেন বিজেপি 22টি সিট পাচ্ছে যদিও এতটা সিটের দাবি বিজেপির পক্ষ থেকে অন্য কেউ করার মতন সাহস দেখায়নি তবে মুকুল রায় তার অংক কষে তৈরি করা রিপোর্টে পরিষ্কার বলেছিলেন ও তার জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন খুব কম সময়ের মধ্য দিয়ে তিনি।
মুকুল রায় বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে রাজনীতি শুধু আবেগ, সততা বা বক্তব্য দিয়ে বা ভীর জডকরে মাঠভরালেই হয়না। রাজনীতিতে সেই বাজিমাত করে যে কূটনীতি, রণনীতি ও অংকের খেলা মাস্টার হবে। মুকুল রায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর মতন ক্লিন ইমেজ বা দক্ষতা বা ভিডপুলার নন কিন্তু তিনি একজন দক্ষ সংগঠক রাজনীতিবিদঃ কূটনীতি ও ভোট অংকের দক্ষ সেনাপতি।
যাই হোক আমরা আবার ফিরে আসি 23 শে মে দিনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। হ্যাঁ বললাম তো বাংলার ইতিহাসে এই দিনটি ঐতিহাসিক । হ্যাঁ সত্যিই এই দিন ঐতিহাসিক ।কারণ অনেকের যেমন অহংকার ধ্বংস হয়েছে তেমনি অনেকেই তার প্রভাব বিস্তার করে সিংহ হয়ে উঠেছিলেন তারা পুনর্মুষিক হয়ে পড়েন।
চারদিকে গেরুয়া রং, গেরুয়া পতাকা ও গেরুয়া আবির মাখা হাজার হাজার মুখ রেজাল্ট ঘোষণা হতেই যেন বিড়বিড় করে একেকটি কোনা থেকে আনাচে-কানাচে থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল। ডিজে মিউজিক এ মাইকে গমগম করছে জয় শ্রীরাম জয় শ্রীরাম ধ্বনি। উদ্দাম নৃত্য চলছে রাম পন্থীদের। তাণ্ডব, ভৈরব বাহিনীর তান্ডব, জয় শ্রী রাম ভক্তরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন। ফুল ভলুম সাউন্ড এ বেজে চলেছে “এক হি নারা এক হি নাম জয় শ্রীরাম জয় শ্রীরাম”। কোথাও কোথাও রাম ভক্তরা হুংকার দিচ্ছেন “রাজ টিলক কি করো তাইয়ারি আরাহে হয় ভগবাধারী।”
পশ্চিমবাংলার অলিতে-গলিতে শহরে প্রত্যেক প্রধান সড়ক থেকে চৌমাথায় গেরুয়া শিবিরের নৃত্য হুঙ্কার। রাত পর্যন্ত চলে এই গেরুয়া মিছিল। রাত বাড়তে শুরু হয়ে যায় বাড়ি বাড়ি হানা ভাঙচুর-লুটপাট তাণ্ডবলীলা আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বহু তৃণমূল নেতাদের ঘরবাড়িতে।
রাতারাতি দল পরিবর্তন শুরু হয়ে যায় । হাজার হাজার তৃণমূল কর্মীরা কাউন্সিলর নেতারা তৃণমূল পতাকা ছেড়ে গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নেন । যারা দল ত্যাগ করতে রাজি হননি তাদের ঘর ছেড়ে চলে যেতে হয় অন্যত্রে অথবা তাদের জায়গা হয় হাসপাতালে বা কোনো নার্সিংহোমে।
আজ 23 শে মে। এই নতুন পরিবর্তনের বর্ষপূর্তি দিবস। আজকের দিনে বাংলার মানুষ তৃণমূল নেতাদের উদ্ধত ও মানুষের টাকা লুট করে ছুঁচ থেকে ফাল হয়ে ওঠা নেতাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। তাদের সমস্ত অহংকার ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন বাংলার মানুষ। আপামর বাঙালি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে গণতন্ত্রে শেষকথা জনতাই বলে। জনতা মানে সাধারণ জনতা। তাই তারা তৃণমূল কে উচিত শিক্ষা দিয়ে বিজেপির পক্ষে রায় দিয়েছিলেন।
কিন্তু তাদের রাযের এই হাল হবে তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। অলিতে-গলিতে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে সমস্ত ক্ষমতাধারী দলের নেতাকর্মীদের ঘরে ঢুকিয়ে দেয় এই রাম ভক্তরা। শুধু তাই নয় যাদের ভোটে তারা এই অধিকার পেয়েছিল , তাদের নৃত্য উৎসবের জয়ের মুখ দেখেছিল যাদের জন্য তাদেরকেও শায়েস্তা করতে ছাড়েনি এই রাম ভক্তরা। এলাকায় এলাকায় সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে ।এলাকায় এলাকায় বাইক বাহিনীর তাণ্ডব দেখে আতঙ্ক ঘর থেকে বের হতেই বন্ধ করে দেন সাধারণ মানুষ তবে অন্যদিকে চলতে থাকে উৎসব মিছিল।
বাংলার পরিবেশ এমন তৈরি হয়ে গেল যেন রাজ্যে ক্ষমতায় চলে এসেছে বিজেপি। তৃণমূলের সমস্ত দাপুটে নেতা বিধায়ক, ঘরে ঢুকে পড়লেন । আর সাধারন মানুষ আতঙ্কে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘর বন্দী করে নিল নিজেকে।
তেইশে মে থেকে 30সে মে পর্যন্ত রাজ্যজুড়ে গেরুয়া সন্ত্রাসে সাক্ষী হলেন রাজ্যবাসী। তবে মাত্র এই সাত আঠ দিনে এই তৃণমূলের গোলগাল চেহারা ভেঙ্গে কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। ভেঙে পড়ে সংগঠন। একের পর এক ক্লাব ,পার্টি অফিস পৌরসভা ,বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ,পঞ্চায়েত তৃণমূল হাত থেকে বেরিয়ে বিজেপির দখলে চলে যায় । চলে যায় বলতে জোর করে দখল নিয়ে নেয় তারা।
এক বছর পূর্তি হয়েছে এই গেরুয়া সন্ত্রাসের যে তৃণমূলীদের শিক্ষা দিতে এই গেরুয়া বাহিনী কে ডেকে এনেছিল বাংলার মানুষ তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন মাত্র কদিনের মধ্যেই। তারা বুঝতে পারেন যে তৃণমূলের বদলে যাদের এনেছেন তারা আরও ভয়ঙ্কর। এই তেইশে মেয়ে মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়েছে তবে এই 23 শে মে থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচুর শিক্ষা নিয়েছেন। তাই তাদের নিজের সংগঠনকে আরো চাঙ্গা করতে তিনি আর নিজে সাংগঠনিক নেতাকর্মীদের উপরে বিশ্বাস রাখেন নি। দায়িত্ব দিয়েছেন অন্য রাজ্য থেকে আসা আরেকজনের উপরে।
শুধু তৃণমূলী নয় এই দিনটি থেকে শিক্ষা নিয়েছেন বিজেপির তাবড় তাবড় নেতারাও। তারা বুঝতে পেরেছেন যদি তাদের কর্মীদের এই আবেগকে ধরে রাখতে পারতেন, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন তাহলে আজ বাংলায় তাদের অবস্থা একটু অন্যরকম হতো। বিজেপির পক্ষে বাংলায় যে মানুষের ঢল নেমেছিল সে দল আর ফেরত পুনরায় তৃণমূলের দিকে ফিরে যেত না। তাই জয় পেলেই হবেনা জয় কে হজম করার মত দলের ভেতরে ব্যবস্থা তৈরি করারও প্রয়োজন আছে।
23 শে মে এই রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া ও দিশা নির্দেশের বর্ষপূর্তিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষা নিয়েছেন তবে আদৌ কি তৃণমূল নেতারা শিক্ষা নিয়েছেন কী ? কারণ কিছুদিন তারা মানুষের দরে দরে ছুটে গেলেও তাদের ফের স্বমহিমায় দেখা যাচ্ছে সেই আগেকার মত। তবে প্রত্যেকে যেন তারা মনে রাখেন গণতন্ত্রের শেষ কথা সাধারণ মানুষই বলবে।