নৈহাটির বঙ্কিমচন্দ্র বিয়ে করলেন হালিসহরে
অবতকঃ ২৬ জুন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম যে শোনেনি সে ভারতবাসীই নয়। বন্দেমাতরম মন্ত্রের উদ্গাতা তিনি। তার ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘কপালকুণ্ডলা’ “রাধারাণী”উপন্যাস ও “কমলাকান্তের দপ্তর” যে পড়েনি সে তো বাঙালিই নয়। ‘আনন্দমঠ’ লিখে বিতর্কিতও হয়ে পড়েন তিনি। সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেই বঙ্কিমচন্দ্র, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র, সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র, শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলেন হালিসহরে।
সেই যে ঘটনা, তা অনেকেরই জানা। বঙ্কিমচন্দ্র তো বাঁকা চাঁদ হয়ে আছে। স্পিকটি নট্! প্রথম পক্ষের ছেলেপুলে হলো না তো কি হয়েছে? বাড়ি নাছোড়বান্দা। বিয়ে করো আরেকবার। রাজি হচ্ছে না সে। হালিসহরের জনৈক তারাচাঁদ বাবু ঘনঘন যাচ্ছেন কাঁঠালপাড়ায়। একটি মেয়েকে দেখাবার জন্য তদ্বির করে চলেছেন বঙ্কিম বাবুর কাছে। এদিকে সিদ্ধান্ত হলো বঙ্কিমের বিয়ে দিতেই হবে।
সঞ্জীব চন্দ্র মানে বঙ্কিমের দাদা আর বন্ধু দীনবন্ধু মিত্র। হ্যাঁ! হ্যাঁ “নীলদর্পণ” খ্যাত সেই দীনবন্ধু। তারা ঠিক করলেন বোট নিয়ে বেরোবেন। কয়েকদিন ধরে মেয়ে খুঁজে বেড়াবেন। তো বঙ্কিমের কানে গেল কথাটা। বঙ্কিম বলল, “আরে! আমিও যাবো।” তাকেও নেওয়া হলো। বঙ্কিমচন্দ্রদের বিশাল বজরা ছিল। সেই বজরায় খাওয়া দাওয়া, স্নানঘর সমস্ত কিছুরই ব্যবস্থা ছিল। চলল বজরা মেয়ের খোঁজে। কথায় বলে, তিন সাহিত্যিক একই বোটে/ সেরা পাত্রী নিশ্চিত জোটে।
কাঁঠালপাড়া থেকে হালিসহর দু- তিন ক্রোশ। তারা হালিসহর পেরিয়ে পৌঁছে গেল বাঁশবেড়ে। আসলে বাঁশবেড়ে তারা এসে পড়লো দীনবন্ধুর শ্বশুর বাড়ি। তারাচাঁদ বাবু, তিনি ঘটকালিতে নেমেছেন। তিনি খবর পেলেন হাওয়ার মুখে। তিনি বঙ্কিমকে অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন মেয়েটিকে দেখে যাবার জন্য। দেখা হলো সেই মেয়ে। রুগ্ন মেয়ে। দাদা সঞ্জীবচন্দ্র অপছন্দ করলেন৷ কিন্তু কি যে হলো! বঙ্কিম বললে, “ওই মেয়েই আমার চাই।”
— কোন গাঁয়ের মেয়ে গো তুমি?
— হালিসহর চৌধুরী পাড়ার মেয়ে। সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির মেয়ে। যাদের জমি নিয়ে জব চার্ণকের কলকাতা তৈরি হয়েছে।
মেয়ের নাম রাজলক্ষ্মী চৌধুরী। বিয়ে হয়ে গেল জুন মাসে। সেটা ১৮৬০ সাল।
হলো তো বিয়ের কথা। এবার বলি অন্য কথা। বঙ্কিমচন্দ্রের যে এত নামডাক, আনন্দমঠ তিনি লিখলেন, জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করলেন, সাম্প্রদায়িক বিতর্ক তুললেন, কিন্তু এই উপন্যাস লেখার পেছনে প্রেরণা দিয়েছে কে?
আমাদের এই হালিসহরের মেয়ে রাজলক্ষ্মী চৌধুরী।
উল্লেখ্য সিপাহী বিদ্রোহের আগুন নির্বাপিত হবার পর পরই এই বিদ্রোহের অন্যতম সংগঠক রাজীবলোচন রায়ের
ফাঁসি হয়। বহরমপুর সেনাশিবিরে বিদ্রোহের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন হালিশহরের মানুষ। বঙ্কিমচন্দ্র এই সিপাহী বিদ্রোহ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আরো উল্লেখযোগ্য রাজীবলোচন ছিলেন রাজলক্ষ্মী দেবীর নিকট আত্মীয়। আনন্দমঠ- এ যে দেশপ্রেমী সন্তান দল গঠনের কথা আছে তাতে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ রাজলক্ষ্মী দেবীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বলে জানা যায়।
বঙ্কিম হুগলি মহসিন কলেজে পড়ত। তখন সে বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃৎ ঈশ্বর গুপ্তের সান্নিধ্যের জন্য মাঝেমধ্যে হালিসহর, কাঁচরাপাড়ায় আসতো। বঙ্কিমের সঙ্গে প্রথিতযশা সাংবাদিক – সাহিত্যিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা বেণীমাধবের বন্ধুত্ব ছিল। বেণীমাধব থাকতেন হালিসহরে। সে বেণীমাধবের কাঁসারিপাড়ার বাড়িতে রাত কাটিয়েছে। হালিসহর ডিবেটিং ক্লাব ও অনেক সভা সমাবেশেও বঙ্কিম সভাপতি হয়েছে। ভাষণ দিয়েছে।
বঙ্কিমের সঙ্গে আমাদের বীজপুরের কত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক! বঙ্কিমের সঙ্গে আমাদের হালিসহরের ইতিহাস তো জড়িয়ে আছে।
সেসব কথা হারিয়ে যাওয়া সোনার পাতা।