রাত কত হইল
রাত কত হইল? জিগির তুলে কালরাত্রির এই অবরুদ্ধ সময়ে রাষ্ট্রীয় ভূত যখন দন্ত-নখর প্রসারিত করে, রক্তাক্ত করছে জনজীবন, তখন ন’দিনের ঐতিহাসিক সৃজনে আলোড়িত তোমার নাটকটির নামটিকে পণ্য করে চৌদ্দতলা লম্বমান ইমারতটি গাঙ্গেয় উপকূলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেহের সর্বত্র নীল সাদা রং মেখে প্রবাহমান জলস্রোতকে ব্যঙ্গ করছে।
নবান্ন নাটকে তুমি যে সংগ্রাম ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলে, দিয়েছিলে গ্রামে ফেরার ডাক, সেই গ্রামীণ বাংলার আঙিনায় এখন পড়ে আছে শত শত আত্মঘাতী শষ্যজীবীর লাশ। কৃষিজীবীকে উপেক্ষা করে স্বৈরাচারীরা আজ শিল্পে বিনিয়োগ নামক ভাঁওতাবাজির সাইরেন বাজিয়ে চলেছে আর একের পর এক বিদেশি বন্দরে নোঙর করছে পুঁজিপতিদের জাহাজ। নবনাট্য আন্দোলনের স্রষ্টা
তুমি,নিপীড়িত মানুষের জীবন দলিল ও গণচেতনার সঞ্চারণকে মূলধন করে যে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলে, নির্মাণ করতে চেয়েছিলে নবান্নের উৎসব,তাকে কলঙ্কিত করেছে ক্ষমতাধর শাসক।
৪৬-এর বাংলা তুমি দেখেছিলে তা আমরা জানি। সেতো তুমি স্বাধীনতা-পূর্ব “জীয়ন কন্যা”-তে মঞ্চায়িত করেছো। “গোত্রান্তর” তুলে ধরেছিলে ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের কূটচক্রান্তে বিভক্ত দেশকে এবং ভিটেমাটি থেকে উৎখাত এক মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষারচেতনা বাড়ানোর সংগ্রামের দিনলিপি। বস্তির শ্রমিকদের শিক্ষিত করার দায়িত্বের সঙ্গে শিক্ষককে করে দিয়েছিলে একাকার।
সত্তর দশকের সন্ত্রস্ত জীবনকে উপজীব্য করেরে সাজিয়েছো দৃশ্যপট “কৃষ্ণপক্ষ” এবং আমাদের উপহার দিয়েছে “আজ বসন্ত”। ”লাশ ঘুইরা যাউক”, কত লাশ আর ঘুরবে পাড়ায় পাড়ায়?এখন বেঁচে থাকলে এত লাশ তুমি রাখতে কোথায়,হে কালের কুশীলব?
প্রোমোটার ও প্রশাসনের যৌথ আলিঙ্গনে ভস্মছাই হয়ে উড়ে যায় খালধারের ঝুপড়ি,একের পর এক বস্তি। “ছায়াপথ”- এ এভাবেই আমরা পেয়ে গেছি বস্তি জীবনের উপাখ্যানের দুঃসহ চলমান চিত্র,যা তুমি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলে।
উত্তর পূর্ব গোলার্ধের সমতল ভূমি অরণ্য পাহাড় সমুদ্র বেষ্টিত এই জনপদে যখন ৪ লক্ষ চাষির আত্মহত্যাকে উপেক্ষা করে দেশকে বেচে দেওয়ার কায়দা রপ্ত করেছে রাষ্ট্র তখন তুমি সেই কবে “আগুন” জ্বালিয়ে “নবান্ন”র মাটির মানুষদের “জবানবন্দি” লিখে ফেলেছো। জোতদারের জবরদস্তির বিরুদ্ধে লাঙ্গলজীবীদের প্রতিরোধক এবং দানবদলনী দশপ্রহরিণীর মর্ত্যে আগমনকে নাটকীয় নৈপুণ্যে মূর্ত করে তুলেছো “দেবীগর্জন”-এ।
₹নবান্ন”-এ মেদিনীপুরের গ্রামের মানুষ, “কলঙ্ক”-এ বাঁকুড়ার সাঁওতাল জীবন, “গর্ভবতী জননী”-তে বাদা অঞ্চলের আদিবাসী বেদেদের চলাচল উপহার দিয়েছো তুমি।
মাটি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলে তুমি। আজীবন মানুষের সন্ধানে হেঁটেছৈ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তুমি বলেছিলে, “আমি মৃত্যুর কথা বলি না, মৃত্যুর বিপ্রতীপে দাঁড়ানো মানুষ আমি। আমাদের কাজ জমি তৈরি করা”। তোমার সেই অসামান্য উচ্চারণ এখনো বাতাসে ভেসে আসে। “আমি তো থিয়েটারের লোক নই, রাস্তায় শিখেছি”।
“মরাচাঁদ” নাটকের হে পবন বাউল,তুমিই তো একদিন গিয়েছিলে গণচেতনার গান। বলেছিলে, নাটক কখনোই স্তব্ধ বাকি নয়। প্রতি মুহূর্তেই অগ্রগমনের নয়া বাঁক।
এই সময়ে কোথাও-না-কোথাও নিশ্চিত নয়া নাটকের মহড়া চলছে,চলছে শ্রমজীবীদের “অবরোধ”- এর প্রস্তুতি।
পূর্ণাঙ্গ নাটকের মঞ্চ সাজিয়েছি আমরা তোমার মহা উচ্চারণে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাদের ধ্বনি, “চলো, সাগরে”। চক্ষুষ্মান দর্শকমন্ডলী নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে বসে ও নিশ্চিত করতে পারছে দক্ষিণ মহাসাগরে ভিড়তে চলেছে একের পর এক সমরাস্ত্রবাহী নৌবহর, নতুন এক গণনাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতিতে।