অবতক খবর : কাঁচরাপাড়া তো ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী হলেও কিছু স্মারক রেখে গিয়েছে এইখানে। যা প্রমাণ করছে এই অঞ্চলে ব্রিটিশের পদধ্বনির কথা। কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এখানে স্থাপিত হয়েছিল বলেই এতসব ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড এখানে ঘটেছিল।
সহেব সুবোদের চালচলনই আলাদা। তাদের মধ্যে ভারতবর্ষকে পরাধীন করে রাখার প্রবণতা থাকলেও কিছু শিল্প-স্থাপত্যের কাজ তারা কাঁচরাপাড়ায় করে গিয়েছিল। সে করেছিল নিজেদের সামাজিক অনুষ্ঠানের কারণে এবং কাঁচরাপাড়াবাসীর স্বার্থে।
বড়দিন এলেই কেকের কথা মনে পড়ে, আসব পানের কথা মনে পড়ে। এ দুটোকে কেন্দ্র করেই এ লেখার অবতারণা।
চার্চ প্রার্থনাগৃহ। যীশু খ্রীষ্টকে কেন্দ্র করে যে ইতিহাস তার সঙ্গে জড়িত এই চার্চ। সে যে ধর্মেরই মানুষ হোক যীশু খ্রীষ্টের কাঁটাজড়ানো মাথাটি ঝুঁকে পড়া, টানটান করে হাতে পায়ে পেরেক গাঁথা মুখটি মাটির দিকে ঝুঁকে রয়েছে। আর পেরেক বিদ্ধ স্থানগুলো দিয়ে রক্ত ঝরছে। এ এক স্মৃতিবিধুর চিত্র। প্রায় উলঙ্গ তিনি। সামাজিক অত্যাচার ধর্মীয় অত্যাচারকে নগ্ন করার প্রচেষ্টা করেছিলেন বলেই বোধহয় তাঁর এই প্রতিকৃতিটি যুগ-যুগান্ত ব্যাপী ঐতিহাসিক হয়ে গেছে।
কাঁচরাপাড়ার খ্রীষ্ট উপাসনা গৃহের কথা বলা যাক। ফার্স্ট এভিনিউ-তে সেন্ট জর্জ চার্চ এখনও রয়েছে। পোড়ো বাড়ির মত অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গির্জার মাথায় ঝোলানো সেই নিস্তব্ধ ঘন্টাটি ভাবছে তার ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণের কথা। শান্ত সমাহিত জায়গায় এই চার্চটি নির্মিত। এখানে নিশ্চিতভাবে উঁচু চরের সাহেবদ ইংরেজদের বড়দিনের উৎসব হত। আর একটি চার্চ রয়েছে ডাঙ্গাপাড়া কলোনিতে তার নাম ইমানুয়েল চার্চ। তৈরি হয়েছিল ১৯২৯ সালে। এখানে সাধারণ শ্রেণীর অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা প্রার্থনা জানাতে আসতো। সামনের মাঠে বড়দিনের মেলা বসত। উৎসব হত। এই উৎসবও ছিল লোক উৎসব।
ধর্ম মানুষকে কতদূর নিয়ে যায় তা খ্রিস্ট ধর্মতেও প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ তা না হলে দুটি শ্রেণীর জন্য কাঁচরাপাড়াতে দুটি চার্চ তৈরি হবে কেন?
এই চার্চগুলিতে আগে ২৫ শে ডিসেম্বর- বড়দিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার স্যাটারডে পালন করা হতো। এখন এইসব দিন প্রার্থনা করা হয় কিনা জানিনা। তবে বাঙালি খ্রিস্টানরা বড়দিনের দিন অর্থাৎ পঁচিশে ডিসেম্বর বিশেষ করে দেখা যায় ডাঙ্গাপাড়া ইমানুয়েল চার্জে সমবেত হয়। আর এই উপাসনালয়ে সমস্ত ধর্মের মানুষদের উপস্থিত হতে দেখা যায় বর্তমান সময়ে। বাঙালি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারণত এই চার্চেই বড় দিনটি পালন করেন।
কাঁচরাপাড়ায় আরও দুটি গির্জা গৃহ রয়েছে। জোনপুর অঞ্চলে।সেই দুটিও খ্রিষ্টধর্মের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজিত। একটি ক্যাথলিক চার্চ অন্যটি প্রোটেস্ট্যান্ট
চার্চ। ওই অঞ্চলে এখনও এই দুটি চার্চে বড়দিনের অনুষ্ঠান পালিত হয়।
বড়দিনের সঙ্গে সান্তাক্লজ জড়িত। তিনি সমস্ত উপহার নিয়ে আসেন। আর আমাদের কাছে তো সুপরিচিত এই বিষয়টি যে সাহেবরা মদ্য প্রিয়। কাঁচরাপাড়া হাসপাতালের পাশ দিয়ে রাস্তায় কয়েকটি কিশোর বট গাছ ছিল। সেগুলি এখন অনেক বিস্তার লাভ করেছে। একসময়ে দেখেছি ওই কো-অপারেটিভের দেওয়ালে পাতা মেলে দিয়েছে সেই গাছগুলি ডালগুলিকে ঝুলিয়ে দিয়ে। দেওয়ালে সেঁটে আছে গ্রান্ড’হ হুইস্কির বিজ্ঞাপন। নির্মাতা উইলিয়াম গ্র্যান্ড এন্ড সন্স লিমিটেড. ডিস্টিমল্লারস্ , ডাফ টাউন, গ্লাসগো এন্ড লন্ডন। যখন দেখেছি তখন বিন্দুমাত্র মলিন হয়নি, মরচে লাগেনি তার ধাতব পাতে একটুও। ইদানীংকালে দেখি সেই বিজ্ঞাপনটি আর নেই। এটিও একটি ব্রিটিশ পদধ্বনির ঐতিহ্যের কথা বলে।
আর এখন তো বাঙালি সাহেবসুবোরা পৌষ পার্বণের পিঠেপুলি– পাটি সাপটা, ভাঁপা পিঠে, গোকুল পিঠে বিসর্জন দিয়ে পাউন্ড পাউন্ড সাহেবি কেক কেনে বড়দিনের আগে থেকেই গান্ধী মোড় অঞ্চলে কবিগুরু রবীন্দ্র পথে সারি সারি কেকের দোকান বসে যায়। কেকের সওদা চলে।