অবতক খবর,১১ সেপ্টেম্বর,বাঁকুড়াঃ- আলোর রোশনাই, নহবতের সুর, শৌখিন যাত্রাপালা, রামলীলা, পুতুল নাচ আর কবি গানের আসরে জমজমাট পুজো মণ্ডপ।এলাকার জমিদার দু’হাত ভরে প্রজাদের তুলে দিচ্ছেন নতুন বস্ত্র। হিন্দু, মুসলিম, জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে পাতপেড়ে পুজোর প্রসাদ খাচ্ছেন। আজ সেই সব ইতিহাস। কাপড়ের সেই ব্যবসা নেই। নেই জমিদারী। নেই সেই সাবেকী আয়োজন।এখন সাধ আর সাধ্যের ফারাকটা ভালো মতোই বোঝেন এঁরা।তবুও এতো সব ‘নেই’ এর মধ্যে ভক্তি আর শ্রদ্ধার মিশ্রণে আছে পুজো। ২৫০ বছর আগে এই পুজো শুরু করেছিলেন চন্দ্রমোহন পাল। আজও নিজেদের মতো করে এখনও মাতৃ আরাধনায় মেতে ওঠেন বাঁকুড়ার ইন্দাসের সোমসার জমিদার বাড়ির বর্তমান সদস্যেরা।
দামোদর আর শালী নদীর সঙ্গমস্থলে সমৃদ্ধশালী জনপদ সোমসার। বাঁকুড়ার ইন্দাসের এই গ্রামের পালেরা এক সময় কলকাতায় বিলিতি বস্ত্রের ব্যবসা বাণিজ্য করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন। আর সেই সূত্রেই দামোদর তীরবর্তী সোমসার গ্রামে গড়ে উঠেছিল পালেদের সুবিশাল জমিদারী। আর সেই জমিদারীর সূত্র ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন দেবী দুর্গা।
কিন্তু এখন সেসব ইতিহাস। জমিদারী প্রথার বিলোপের সঙ্গে সঙ্গেই পাল পরিবারের সেই অতীতের বনেদীয়ানা না থাকলেও কোন রকমে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন বর্তমান বংশধরেরা। কথিত আছে, সোমসারের পালেরা বিলিতি বস্ত্র ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সুবিশাল জমিদারি পত্তন করেছিলেন। সোমসার এলাকায় মোট ছ’টি তালুক কিনেছিলেন তিনি। জমিদারী প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সময়ের দাবি মেনে জমিদার বাড়িতে শুরু হয় দুর্গা পুজো। এক সময় এই বংশের চন্দ্র মোহন পালের হাত ধরে যে উত্তরোত্তর পালেদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল আজ সেসব ইতিহাস। শোনা যায়, এই চন্দ্রমোহন পাল নিজের ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতার গঙ্গা নদীতে একটি ঘাট নির্মাণ করেন। যে ঘাটে বিদেশ থেকে জলপথে কাপড় ভরতি জাহাজ এসে থামতো।
পুজোর ঠিক আগে এখানকার প্রজাদের জন্য সরাসরি কলকাতা থেকে জলপথে কাপড় বোঝাই বজরা এসে থামতো সোমসার সংলগ্ন দামোদরের ঘাটে। বস্ত্র ব্যবসা সেই সময় লাভজনক ছিল৷ কলকাতা সহ বর্ধমানে বিশাল বিশাল বাড়ি সহ জমিদারী পরিচালনার সোমসার গ্রামেও ছিল সুদৃশ্য বিশালাকার বাড়ি। কিন্তু এখন সোমসারের সেই পলেস্তারা খসে খসে পড়ে। সাধ্যের অভাবে বর্তমান বংশধরেরা সেই ঐতিহ্যবাহী বাড়ি সংস্কারের কাজেও হাত লাগাতে পারেননি। কিন্তু এতও সবের পরেও একটা ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছেন সোমসারের জমিদার বাড়ির সদস্যরা। সেই সময় ব্যবসার প্রয়োজনে যে যেখানেই থাকুন না কেন পুজোর চারদিন সোমসারে ঠিক পৌঁছে যেতেন। সেই ধারাবাহিকতা মেনে বর্তমান প্রজন্মও কর্মসূত্রে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন পুজোর দিন গুলিতে ঠিক বাড়িতে উপস্থিত থাকবেন। আগে যেখানে আলোর রোশনাই, রামলীলা, কবিগানের আসরে সোমসারের জমিদার বাড়ির পুজো মণ্ডপ গম গম করত৷ এখন সেসব ইতিহাস। সাধ থাকলেও সাধ্যের অভাবে সেসব বন্ধ হয়েছে কবেই। তবুও ঐতিহ্যের টানে এখনও অসংখ্য মানুষ প্রাক্তন হয়ে যাওয়া সোমসার জমিদার বাড়ির পুজোতে অংশ নেন। সোমসার জমিদার বাড়ির বর্তমান সদস্য শ্যামসুন্দর দে বলেন, ‘আমাদের ছোট বয়সেও পুজোর যে জাঁকজমক দেখেছি৷ তার অনেকটাই এখন কমে গিয়েছে। তবুও কষ্টের মধ্যেও নানান প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে এখনও আমরা পুজো চালিয়ে যাচ্ছি। আগে বলিদানের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে শঙ্খচিল এসে উপস্থিত হত বলে শুনেছি। পরে বর্ধমান রাজবাড়ির সর্বমঙ্গলা মন্দিরের তোপধ্বনি শুনে বলিদান হত। বর্তমানে পঞ্জিকা নির্ধারিত সময় ধরে অষ্টমী ও নবমী তিথিতে মাস কলাই বলিদান হয়। একই সঙ্গে ব্যবসা বর্ধমান, কলকাতা, বার্ণপুরে পরিবারের সদস্যরা বসবাস করলেও পুজোর দিনগুলিতে সোমসারের বাড়িতে তারা ঠিক হাজির হয়ে যান৷