অমারাত্রির এই দেশে এখনও মানুষের মুখে জ্যোৎস্না গড়ায়। কুরুক্ষেত্রে রক্তস্রোত বয়ে গেলেও বসন্ত আসে।

হিংসা কি জ্যোৎস্না ঠেকাতে পারে? হিংসা কি রোদ্দুর ঠেকাতে পারে? হিংসা কি প্রতিরোধ করতে পারে তারুণ্যের ঋতু বসন্তবেলাকে?

নেমে আসে বসন্তবাহার। সেই রক্তাক্ত বিলাপের মধ্যেও নেমে আসে বসন্তের রক্তিম উপহার। ফুল ছড়িয়ে পড়ে রণক্ষেত্রে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা লাশের উপর। গুলিবিদ্ধ লাশ, অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহ, প্রস্তরাঘাতে নিহত শব পড়ে আছে প্রান্তরে। আর পলায়নরত নারী, যুবতী, কিশোরী কোথায় ছুটে যায়!

অন্তঃসত্ত্বা গর্ভিনী নারীরা তবে কি করে? লাশকাটা ঘরে মর্গে অপেক্ষা করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সেই প্রিয়তম মানুষটির মুখ অস্তবেলায় অন্তত একবার দেখবে বলে চোখের আকুতি স্থির হয়ে থাকে।

নারী পুরুষ কি পৃথক? এক অপূর্ব দ্বৈত সত্তা। একেই বলে পরিপূরক এবং পরিপূর্ণতা। জীবন এবং মৃত্যুতে দুটি সত্তাই একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে। জীবনের শেষ পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে কাছে পেতে চায়।

মননে সাম্যের পতাকা ওড়ে। ওড়ে এক মৃত্যুঞ্জয়ী ভালোবাসার নিশান। নারী শুধু অর্ধেক আকাশ নয়, মানবের শুদ্ধ শ্বাস, নিরাপদ আশ্রয় আবাস। নাহলে শিশু ভ্রুণটি কি করে জননীর গর্ভের গভীরতায় বিচিত্র আধারের আঁধারের মধ্যে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যায়!

নারীদিবস বলে কিছুই হয় না। প্রতিদিনই নারীদিবস। বিপন্ন পৌরুষ যখন দিশেহারা তখন নারীত্ব মাতৃত্বের দায়িত্বে অন্য এক বীরত্বের প্রত্যয় নিয়ে আসে, দাঁড়ায় তার পাশে।

যেখানে জমি, মাটি, মাথাগোঁজার যুদ্ধ সেখানেই নারীর ভূমিকা প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক।

তেভাগা, তরাই, তেলেঙ্গানা, শাহিনবাগ, পার্ক সার্কাস, স্বাধীনতা উদ্যান তখন মৌন অথচ মুখর ময়দান হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী রক্তকরবী হাতে নিয়ে উঠে আসে। রঞ্জন ছাড়া কি নন্দিনী হয়?
কী বলে তোমার পাভেলের মা! ইনকিলাবি স্পর্ধা দেখিয়ে রুটির ভেতর লুকিয়ে বিলি করে সময়ের ইস্তেহার। ঋত্বিক ঘটককে তুমি কাঁদতে দেখোনি? দেশ, বাস্তুভিটে কিভাবে নারী থেকে উন্নীত হয় মা-এ। দাদার কাছে বাঁচতে চাইবার অশ্রুসজল কোন্ নারীকে তুমি দেখেছিলে মেঘে ঢাকা তারায়?
জীবন সংগ্রামে লিপ্ত সেই নারীটি। নাম ছিল তার নীতা। সুবর্ণরেখায় বাগদি বউ সীতার লড়াই তুমি দেখোনি? কোমলগান্ধারে অনসূয়াকে? সেই নারীরা কি কিছু দিয়ে যায় নি?

ঋত্বিক তাদের কাছে পেয়েছিল জেহাদের ভূমিকা। বাঁচবার তীব্র আকাঙ্খা। ঋত্বিক নারীকে করেছে মিথ। তিতাস একটি নদীর নাম-এ দেখিয়েছে সৃজনশীল জগদ্ধাত্রীকে। আর সুবর্ণরেখায় দেখিয়েছে সর্বনাশী, সংহারী মাতৃমূর্তি কালিকাকে। যুক্তি তক্ক গপ্পো-তে গেয়েছে, কেন গো চেয়ে আছো মা!
পুরুষ ঋত্বিক নারীকে সঙ্গে করে নিয়ে বেঁচেছে।

এই বিশ্বের আধার মাটি। এই বিশ্বের আধার তোমার আমার প্রিয় নারী। যে ক্রমাগত পরিপূর্ণতায় হয়ে দাঁড়ায় তোমার মা-টি।

নারীদিবসকে স্বাগত জানায় বসন্ত। বসন্ত কেন? বসন্ত তারুণ্যে উজ্জ্বল। সে নব প্রজন্মকে বলে, আমাকে দেখো। কৃষ্ণচূড়া, অশোক, কিংশুকের রক্তিম উজ্জ্বল বিস্তারকে দেখো। সাম্যের গানে বৃক্ষে ফুল ফোটে, ফল ধরে। পরাগ রেণুর গর্ভাধানে আমি আজ রক্তিম পলাশ।

সমতার এখানেই জয়গান। যে নারীটি বাজারে সব্জি বেচে, গ্রাম থেকে নিয়ে আসে হাঁস মুরগির ডিম, যে নারীটি ফুটপাথে ফুল বেচে— আহার্য সৌন্দর্য বেচে শ্রমের দুটি পয়সা নিয়ে যায় ঘরে। যে পুরুষটি খনি, খাদানে, চটকলে, ভাগওয়ালা-বদলি হয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, যে পুরুষটি সারাদিন ভ্যানরিক্সা চালিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে তখন তারা শ্রমের জীবন ভুলে শ্রমিষ্ঠ, শ্রমিষ্ঠা হয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়। জীবন জীবনকে দেখে। পরস্পর পরস্পরের নিকটে আসে দ্বৈতসত্তার এক অপূর্ব সাম্যের উন্মোচন ঘটে।

জীবন এভাবেই শুদ্ধ জলস্নানে মেতে ওঠে। এই সমতার জন্যই এত আকুতি। মানুষের বেঁচে থাকা। তোমরা যখন পরস্পরকে ভালোবাসো তখন কে পুরুষ, কে নারী! পরস্পর একক হয়ে দাঁড়ায়।

পরস্পর পরস্পরকে নিজের মধ্যে খুঁজে পায় তখন নারী বা পুরুষ কোথায়!