তমুকে রীতিমতো রেগে বকুনি দিয়েছিল ঋজুদা
তমাল সাহা
তমু রীতিমতো বকুনি খেলো শেষ পর্যন্তৃ। অনেক কাকুতি-মিনতি এবং অনুরোধ সত্বেও তিনি দার্ঢ্য গলায় বললেন, না, ইন্টারভিউ দেবো না।
তখন সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রইলো তমু।
মানুষ মরে গেলে খণ্ড-খণ্ড হলেও ভেসে ওঠে পুরাতন চিত্র-দৃশ্যাবলী। হয়তো বা কোনোভাবে কোনোক্রমে এসবের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তমু। জীবনের জলপ্রপাতে তমু সেইসব শব্দ-ধ্বনি শুনতে চায়। টুকরো টুকরো ঘটনার স্মৃতি তখন সরব হয়ে উঠতে চায়, জানান দিতে চায় মানুষের কাছে।
কল্যাণী বইমেলা 2018 উদ্বোধন করছেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেবগুহ
ছবিঃ সুখেন্দু সিনহা
তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তমুর অনেকবার। কারণ তমু যে দপ্তরে কাজ করতো তার সঙ্গে তার জীবন-জীবিকা জড়িত ছিল। তখন তমু বসতো মানে কাজ করতো যে দপ্তরে তার একটি শাখা দপ্তর ছিল তিন নম্বর লাল বিল্ডিয়ে যা ব্রিটিশ আমলে তৈরি, তাকে বলা হতো ট্রেজারি বিল্ডিং। তাকে ঘিরে রয়েছে রাজভরন, আকাশবাণী, বিধানসভা ভবন, টাউন হল, কলকাতা হাইকোর্ট এবং ইডেনের মাঠ।
বিশাল ‘মাপ’-এর মানুষ তিনি। সেই পরিমাপ করা তমুর পক্ষে সম্ভব নয়। দেখতে রাশভারী হলেও দিলখোলা,স্পষ্ট কথাবার্তার মানুষ। তমুর কাছে তিনি এক অদ্ভুত ফর্সা মানুষ। তার অফিস ছিল ওয়াটার্লু স্ট্রীটে। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের পাশের রাস্তায়। তমুর অফিস থেকে পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের পথ। চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট মানুষ তিনি। এই মানুষ কি করে লেখক কবি গায়ক হয় এমন একটি অলীক ভাবনা ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। পরিচিত মুখ। তমু অনেকবার তার অফিসে গিয়েছে হিসাবপত্র বিষয়ক কথাবার্তায়।
আসলে ঋজুদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তমুর,সেই সত্তর দশকের বারবেলায়।’ঋ’ বর্ণটির জন্য আকৃষ্ট হয়েছিল তমু তার প্রতি। ছোটবেলায় তমু জানতো ‘ঋ দিয়ে’ শুধু মাত্র ‘ঋষি’ হয়। তমু মনে করতো ‘ঋ’ দিয়ে তৈরি শব্দগুলো অদ্ভুত, যার মধ্যে পবিত্রতা শুদ্ধতা লুকিয়ে থাকে। তমু তার লেখাতে খুঁজে পেল ঋজু ও ঋভু শব্দ দুটি। তারপর ঋক,ঋত, ঋদ্ধ,ঋক্ষ — এই শব্দগুলো তমুর খুব পছন্দ হয়ে যায়।
থাক এসব। এখন মানুষটি সম্পর্কে বলি। মানুষটির সঙ্গে শেষ দেখা এবং বকুনি খাওয়ার গল্প, সেটা। কল্যাণীর বইমেলা। ডিসেম্বর মাস, ২০১৮। তিনি এসেছিলেন বইমেলার উদ্বোধন করতে। তমুর সঙ্গে রঞ্জন গিয়েছিল তার সাক্ষাৎকার নিতে। বইমেলার সম্পাদক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছিল, সাক্ষাৎকার নেবার অনুমতিও পেয়েছিল তমুরা। তিনি বইমেলা উদ্বোধনের প্রদীপ প্রজ্বলন করলেন, বক্তব্য রাখলেন এবং গানও গাইলেন। মানুষটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ,পুরাতনী গান,টপ্পায় খুবই দক্ষ ছিলেন।গায়কী ছিল মনোমুগ্ধকর। আসলে তার অর্ধেক আকাশ ছিলেন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ঋতু গুহ।
সেই বইমেলার অনুষ্ঠানে তমুদের অঞ্চলের সুপরিচিত লেখক হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত তাঁর সান্নিধ্যে ছিলেন। ঋজুদার সঙ্গে তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক দেখলো তমু। হিমাদ্রি তমুকে দেখে বলে, দাদা, কি ব্যাপার? তমু বলে, একটা সাক্ষাৎকার নেব। হিমাদ্রি বলে, দাঁড়ান, হয়ে যাবে। তাঁর সঙ্গে হিমাদ্রির এতো সান্নিধ্য এবং সংযোগের আধিক্য দেখে তমুর মনে হয়েছিল মানুষটির সাক্ষাৎকার নিতে কোনো অসুবিধে হবে না। এতো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও হিমাদ্রির প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো তখন তমু সরাসরি তাঁর কাছে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, একটু, একটু সময় দিন। মানুষটি তমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, শরীর ভালো নয়। তাড়া আছে। তমু তার কথা থামিয়ে বারবার বলে চললো, একটু, একটু সময় দিলেই হবে।
এবার তিনি রীতিমতো রেগে বকুনি দিলেন, বলছি না, পারব না। তমু ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এল। হিমাদ্রিরও এতে মন খারাপ হয়েছিল।
সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে গেল তমুর। তিনি চলে গেলেন ২৯ আগস্ট,২০২১, রবিবার। তখন রাত ১১টা ২৫। তিনি এখানে এসেছিলেন পরিভ্রমণে ২৯ জুন,১৯৩৬।
তিনি হলেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ।
তমু তাঁকে সামনে রেখে আজ কিছু শব্দ সাজালো।
ঋজুদা চললে কোথায়
ঋজুদার সঙ্গে যে যায়নি জঙ্গলে
সে আর কি করে জানবে প্রকৃতি
চিনবে কি করে অরণ্যরাজি?
একটু উষ্ণতার জন্য যে নগ্ন নির্জনে
হলুদ বসন্তে হাত রাখেনি
সে কি জানে ভালোবাসার?
সবিনয় নিবেদন-এ চিঠির পর চিঠি
প্রেমপত্র হতে হতে শেষপর্যন্ত
পাখি পাখিনীর মতো স্বাধীন উড়াল দেয়
এসব সে জানতো।
কোজাগরে কে বা কারা জেগে থাকে
জীবন যুদ্ধের চেতনায়, সে বলে যায়।
সংসার কখন পুতুল খেলা
সে আমাদের জানিয়ে দেয় আর বলে, নিজেকে ভালবাসতে প্রতিদিন একবার আয়নার সামনে দাঁড়াতে হয়।
যে যতই যা লিখুক তার অক্ষর দিয়ে সাজানো শব্দমালার উপন্যাস যে পড়েনি সে কি কখনো কৈশোরের উত্তরণে স্পর্ধিত যৌবনকে
স্পর্শ করতে পারে!
মাধুকরী আসলে কি?
দোরে দোরে যাওয়া এবং কি জন্য—
এতে মধু সংগ্রহের কোন জীবন রসদ আছে
হয়তো তারই অনুসন্ধানে এবার ঋজুদা পর্যটক থেকে পরিব্রাজক হয়ে গেল
লুকিয়ে পড়লো আরো কোনো ঘনতম গভীর অরণ্যে!