অবতক -এর বিশেষ প্রতিবেদন

শাসকের মঞ্চে দাঁড়িয়েঃ সোচ্চারিত সত্য স্বর

তমাল সাহা

প্রদীপে এতো আলো থাকে? জীবন আসলে কি? জীবন কি চায়? কুমোরের চাকার উপর বসানো এক তাল মাটি। চাকা ঘুরে চলেছে। হাতের নৈপুণ্যে হয়ে উঠছে ভাতের হাঁড়ি,মালসা,জলের গ্লাস,প্রদীপ কত কি! সবই কুমোরের ওস্তাদি, কারিগরের হাতের কেরামতি। নাট্যশিল্পীও এইভাবে বানানো যায় নাকি! সে বলে, যায়। শ্রম নিষ্ঠা আগ্রহ থাকলে নিশ্চয়ই যায়।

সেই কবেকার কথা। কোনোদিন দেখা হয়েছিল বহরমপুরে। এবার তাকে দেখতে চলে এলুম কলকাতা। সঙ্গে বন্ধুজন নাট্যকর্মী বাবলু দাশগুপ্ত,অভিনেতা অচিন্ত্য দত্ত।

সহজ সরল চলন বলন তার। মুখাবয়বটি দেখবার মতো। আর কন্ঠনালী হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে স্পষ্ট উচ্চারণ সোজাসুজি। সিগারেটে দম দিয়ে বলে, জীবন কি কারো ধার ধারে? জীবন তার নিজের মতোই চলে। সজোরে প্রকাশ্যে বলে, বাংলা প্রবাদগুলি মনে রেখো–নেপোয় মার দই, আর নেংটার নেই বাটপারের ভয়।

কাজ তো শুরু করেছিলুম অনেক আগেই– সেই ১৯৬৮ সালে। প্রান্তিক নাট্য দলে রক্ত করবী নাটকে। আমরা নাটক করি নেতারাও নাটক করে। ফারাক আছে,ভাইরে ফারাক আছে।

আমি বলি,এই যে নাট্য আকাদেমির জীবনকৃতি সম্মান পাবার পর তুমি স্বাগত ভাষণে বললে আর কেউ তো বললো না?

সে বলে,কেউ বললো, না বললো তাতে আমার কি আসে যায়? আমি বলার ও জানানোর প্রয়োজন আছে মনে করেছি তাই বলেছি।আমি তো আর কাউকে বারণ করিনি, তোমরা কেউ বোলো না!

আমি বলি, তোমাকে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জাপ্টে কোলে তুলে নিয়ে যে অভিনন্দন জানালো তা তো অভাবনীয়!

সে বলে, তা তুমি কি বলছো! সে তো স্বতঃস্ফূর্ততায় এটা করেছে,ভালোই তো। সম্মান স্বীকৃতি দিয়েছে আমাকে। তাকে অভিনন্দন। আবার বলি,‌তুমি কারা বিভাগের আইজি বংশীধর শর্মা এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখ করেছো!

তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল? যে কাজের জন্য আমার নাম তাতে তাদের অবদান, তারা সুযোগ করে দিয়েছে, প্রবল উৎসাহে আমাকে এগিয়ে দিয়েছে, তাদের স্বীকৃতি দেবো না? সত্য কথা প্রকাশ্যে বলবো না?

না হলে যে আমার অপরাধ হয়ে যাবে ভাই। আসলে তুমি বলতে চাইছো শাসনকাল মানে ক্ষমতায়ন পাল্টে গেছে আমি ভয় পেয়ে যাবো? আরে, সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। সেটা সত্য।সেটা সবাই দেখে। সত্য, সত্যই। সেটা দেখতে সাহস লাগে নাকি? তাহলে কথাটা বলতে সাহস লাগবে কেন?

সে আরো বলে, আসলে ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে।

কারিগরের নাম প্রদীপ ভট্টাচার্য্য। নাট্য কারিগর।অভিনেতা নির্মাণ শিল্প নিয়ে ব্যস্ত। বেলাশেষে, বেলা শুরু চলচ্চিত্রে মানুষ তাকে দেখেছে। তার সহজ স্বাভাবিক নৈপুণ্যের অভিনয় বাচন ভঙ্গিকে দর্শকরা-শ্রোতারা মান্যতা দিয়েছে। এটা নিশ্চিত তাকে আরো পরিচিতির আলোকে এনেছে। চরিত্রে নামকরণের কারণে সে ইতিমধ্যে ‘গণশা’ নামে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে। আসলে সে অন্য মাপের শিল্পী। ওস্তাগর। তার শারীরিক গঠনে এক আশ্চর্য মানুষকে আমি খুঁজে পাই। দর্জি যেমন শরীরের মাপ নিয়ে কাপড়ের ছাঁট করে নিখুঁত জামা বানিয়ে খরিদ্দারের গায়ে পরিয়ে দেয়,সেও নির্মাণশৈলীতে যেন এক ওস্তাগর। দর্জির চেয়েও সে বড়। দর্জি তো বহিঃপ্রকাশ বহিরঙ্গ চটকদার করে তোলে, সে অন্দরমহলে পর্যন্ত চলে যায়। নাট্যকর্মীদের হৃদয়ের অতলে সে ডুব দেয়। এখানে নেপোয় মারে দই প্রবাদটি বাস্তবিকই প্রযোজ্য। ক্ষীর বানালো হালুইকর আর খেয়ে গেল জাদুকর।

কারাগারের যাবজ্জীবন বন্দীদের নিয়ে কাজ তো সেই শুরু করেছিল। সেটা শুরু ২০০৬ সাল। ৫৫ বছর ধরে সে নাটকীয় জীবন অতিবাহিত করেছে। নাটকের জীবন, না জীবনের নাটক কে জানে! উৎপল দত্ত, কুমার রায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর সান্নিধ্যে এসেছিল। সান্নিধ্যে বলছি কেন, সে তো নাটক শিখেছে তাদের কাছ থেকে। বিদেশেও প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সে তো নিজেই অকপটে একথা বললো আমাকে। ১৫ বছর ধরে সে করেছে বাস্তবতার জীবন শিল্পচর্চা, থেরাপি ইন হোম মানে কারাগারে কয়েদিদের জীবনের

অভিজ্ঞতা। বহমপুরের যাবজ্জীবন জেলের ভেতরের মানুষরাই তো তাকে শিখিয়েছে। সে বলে,আরে কয়েদিরা প্রশ্ন তোলে, রবীন্দ্রনাথ কি জেল খেটেছিলেন? এই যে অনুসন্ধিৎসা আর জিজ্ঞাসা এর মধ্য দিয়ে আমিও শিক্ষিত হয়ে উঠি। আর এই কাপালিক সময়ে সুনৃত

বা অনৃত ভাষণে সে প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছে, স্বীকার করে নিয়েছে মূল উৎসে যারা তাকে প্রেরণা যুগিয়েছিল তাদের কথা।

২৬ নভেম্বর ২০০৬ সালে সে শুরু করেছে নাট্য জীবনের নব অধ্যায়। কয়েদিদের বানাও নাট্যশিল্পী। যক্ষপুরী থেকে বার করে আনো কয়েদি। শুরু হলো রবীন্দ্রনাথের নাটক তাসের দেশ দিয়ে। নাটকটি মঞ্চস্থ হলো ১৭ই মে ২০০৭। প্রকাশ্যে এলো প্রশাসনিক ঘেরাটোপ অতিক্রম করে। নাটক চলে গেল দিল্লি ১৭,১৮,১৯ নভেম্বর,২০০৭ মঞ্চস্থ হলো নয়াদিল্লির প্রগতি ময়দানে। প্রধান বিচারপতি বালকৃষ্ণাণ দেখে তো মুগ্ধ। কয়েদিদের নাটক দেখছে বিচারপতি!

সে বলে, নাটক দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলুম তো সব সাংসদকেই। এলেন শুধু আমার অঞ্চলের সাংসদ অধীর চৌধুরী। নাটকের শো থেকে উঠে এলো অর্থ। সেই অর্থ কারাগারের আইজি- হাতেই অর্পণ করলুম। আর্থিক পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ টাকা। বললুম শর্ত একটাই,এই অর্থ দিয়ে তৈরি হবে প্রিজনার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড।

কয়েদিরা কুশীলব। তারা মঞ্চায়ন করেছে ৬২ শো। সে বলে, জেলবন্দিদের মধ্যে চালিয়ে দিলাম রবীন্দ্রনাথকে। তারা লালন করলো রবীন্দ্রনাথকে। নাটক করলুম রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনী, রক্তকরবী। কারাগার হয়ে উঠল সংশোধনাগার।

আমি বলি,ওই যে কয়েদিদের মধ্যে বিয়ে দিলে!

আরে জেলবন্দী মুসলমান মেয়েটির সঙ্গে হিন্দু ছেলেটির প্রেমের কথা বলছো? ভালোবাসাই তো জীবন। জেলখানা কি আটকে রাখতে পারে ভালোবাসা আর জীবন? ২৭ মার্চ ২০১৯ নাটকই তো দুটি জীবনের জুটি বেঁধে দিল। নাটক পারে জীবন গড়তে। অনুঘটক হলাম আমি। ইতিমধ্যে তাদের দুটি যমজ প্রজন্ম ভূপৃষ্ঠের মুখ দেখলো। একটির নাম রাখলাম রবীন্দ্রনাথ, অন্যটির নাম ভানু সিংহ। কারণ আমি যে অনুঘটক। পিতামহ-মাতামহ দুই ভূমিকায় ময়দানে অভিনয় করল কে? সে তো আমি।

তারপর, এই ২৫ জুন ২০২২ এলো। আরে আমি কি এসেছি নাকি পুরস্কার নিতে, দুটি সত্য কথা বলতে তো আমি এসেছি।

শিশির মঞ্চে এসে প্রকাশ্যে সে জানিয়ে দিলো তার এই পুরস্কারের আর্থিক সম্মান দিয়ে সে দুটো ফিক্সড ডিপোজিট করে দিতে চায়। কিসের জন্য, কাদের জন্য? তার ওই দুই প্রজন্মের আগামীর জন্য, শিক্ষার জন্য। যা থেকে শিক্ষিত হয়ে বড় হয়ে উঠবে রবীন্দ্রনাথ ও ভানুসিংহ। তখন কলকাতার গান্ধী মূর্তির পাদদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত যোগ্য অথচ বঞ্চিত প্রজন্মরা চাকরির দাবিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রশাসনিক ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে চালিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টান্তমূলক আন্দোলন।

সে নিজে অভিনয় করেছে হারানের নাতজামাই, মুক্তধারা, অশ্বমেধ, বিসর্জন, আর্তুরো উই, সোক্রাতেস, চাঁদ সদাগর, উইঙ্কল টুইঙ্কল আরো কত সব নাটক। ১৯৮৬-তে তৈরি করেছে বহরমপুর রেপোর্টরি থিয়েটার।

আমি বলি, ওই লোকশিল্প নিয়ে তোমার কাজ..

সে বলে,জানোতো দেশজ ঘ্রাণ আমি খুঁজে বেড়াই। মাটি আমাকে টানে। ওই যে তোমরা বলো ফোক মানে লোকশিল্প–গম্ভীরা আলকাপ এসব প্রয়োগে নাটক গভীরতা পায়। এই বলে সে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে দিল শিশির মঞ্চের আঙিনায়।

প্রদীপ কে না দেখেছে! প্রদীপে এতো আলো থাকে নাকি? এইসব ক্রিয়াশীল মানুষের সান্নিধ্যে বাঁচার ইচ্ছা জাগে। এই ফতুর জীবনে আমি তো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারিনি। তাই তাদের কথা অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে গড়ে তুলতে যে ভালো লাগা তার মধ্যেই নিজের সুখ খুঁজে চলি।

 

ছবিঃ 

এক) নাট্য কারিগর প্রদীপ ভট্টাচার্য ও প্রতিবেদক 

দুই) সম্মান প্রাপ্তিতে শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর আনন্দ প্রকাশ 

তিন) নাট্য কারিগরের কোলে দুই নাতি রবীন্দ্রনাথ ও ভানুসিংহ