অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন
কলমের জোর/তমাল সাহা
এই বঙ্গমজ বাতাস বনজ বৃক্ষ সমূহ, বিস্তীর্ণ ছলাৎ ছলাৎ জল ও দিগন্ত বিস্তৃত জনপদ ছেড়ে কতদূর যাবে? কত মানুষের মুখ যে লুকিয়ে থাকে শান্ত নীরবে!
কোনো একদিন এই গাঁয়ে গঞ্জের আশ্রম ছাউনিতলে- বাউল আখড়ায় দেখা হয়েছিল শ্মশ্রুবান দুই এলিটের, তোমরা যাকে বলো সেলিব্রিটি।
লালন ফকির জীবনের গানে বাউল বাতাসে তার সুর যেমন ভাসিয়েছিল তেমনি কাঙ্গাল হরিনাথ কলমীয় ভাষায় সংবাদে এবং বাউল সংগীতেও অনেক অনেক দূর চলে গিয়েছিল।
গায়ক কথাকার হয়ে গেলে হৃদয়ের পাত্রে ও শ্রবণের আধারে ধরা থাকে চিরায়ত সুর। বেলা গৈরিক রঙে ছেয়ে গেলে বাতাস বলে চলে– হরি দিন তো গেল সন্ধ্যে হলো পার করো আমারে….
সবারই চোখে সন্ধ্যে নেমে আসে। সে শুধু গানের ধরতাই ছড়িয়ে দিয়েছিল এই আকাশের নিচে ঊর্ধে যাবার আকাঙ্ক্ষায়। শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ রূপান্তরিত হয়ে গেল ফকির চাঁদ বলে।
ঐশ্বর্যবান হলেও মানুষ কি নিঃস্ব হয়? হয় কি কাঙাল? কি জানি! কাঙাল কাকে বলে গো, বাতাসও করে কানাকানি। গীতিকাব্যের ভনিতায় তুমি তো নিজেকেই কাঙাল বলে ঘোষণা করো।
কুষ্টিয়া জেলা, কামারখালি গাঁও।সেই বাজারে কাপড়ের দোকানের দুপয়সায় রুজির কর্মচারী ছিল সে। খরিদ্দারের তামাক সাঁজো কাপড় গোছাও আর রাতে সারাদিনের হিসেব-নিকেশ– এইতো ছিল তার জীবনপাঠ। পরে নীলকর সাহেবদের কুঠির কর্মচারীও হয়েছিল।
জগত তো দৃশ্যমান। কত কি দেখে সে! মাটি ছুঁয়ে থাকতে চায় তার পা। প্রত্যয়ী পদাতিক হয়ে উঠলে হাত নিশপিশৎকরতে চায় কলমে। কলমে উঠে আসে চাষাভুষোর জীবন যন্ত্রণার গদ্য। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার, জমিদারি শোষণ, পুলিশের দৌরাত্ম্য শব্দচিত্র হয়ে ওঠে। যুগসন্ধিক্ষণের কবি ও সাংবাদিক কাঁচরাপাড়ার ভূমিপুত্র ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকরে হাত পাকিয়ে ছিল সে । সেই পরে নিজেই হয়ে উঠলো সম্পাদক। আর প্রকাশ করলো গ্রামবার্তা প্রকাশিকা। সেটাই এপ্রিল মাস ১৮ ৬৩ সাল। কাগজ মাসিক, দাম তখন ৫ আনা। ১৮৬৪ সাল কাগজ উন্নীত হলো পাক্ষিকে। তারপর ১৮৭১ সালে তা হলো সাপ্তাহিক। মূল্য এক আনা।
পুলিশ সম্বন্ধে কি লিখেছিল সে? ‘বিকারগ্রস্ত রোগীর হিক্কার উপসর্গের ন্যায় পুলিশ প্রজার উপসর্গ হইয়াছে।’ ঘুষ শব্দটিকে সে বানিয়েছিল ‘হাত পাতা’। সে লিখলো, ‘আদালত আমলাদিগের হাত পাতা রোগ’–এর কারণে মূলত দরিদ্র প্রজারাই শেষ পর্যন্ত বিপর্যস্ত হইতে থাকেন। বাংলার গ্রামবাসীদের দিশাহারা অসহায়তা বোঝাতে সে লিখল, ‘ দেশ নষ্ট কপটে,প্রজা মরে চপটে, কি কি করবে রিপোর্টে’–এই শীর্ষনামে সে নিয়মিত প্রতিবেদন লিখে চলে। সেই সাম্রাজ্যবাদী শাসনে সে সংবাদের হেডলাইন করলো, ‘গরু চোর ম্যাজিস্ট্রেট’– ভাবা যায়!
বড্ড ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিল সে। সোচ্চার হয়ে প্রতিবেদন লিখেছিল সে তো বিশাল কাহিনী! শিলাইদহে জোড়াসাঁকোয় যে ঠাকুর পরিবারের জমিদারেরা মুলুক চালান তাদের প্রজা নিপীড়নের নির্মমতার বিরুদ্ধে। সে দুর্বার কলম-ভাষ্য! ফলত, কি হয়েছিল? শারীরিক আক্রমণ যাকে বলে শুদ্ধভাষায় নিগ্রহ। এই আক্রমণ থেকে তাকে করেছিল রক্ষা করেছিল কে? সেও এক ইতিহাস! সংবাদটি যখন গিয়ে পৌঁছলো লালন ফকিরের কাছে, বাউল গীতিকার রুদ্রতেজে তার দলবল সহ এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল কাঙাল হরিনাথের পাশে। ফিরে গিয়েছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারের সেই লেঠেল বাহিনী। বাউল লালন ফকিরের বাহিনী তাকে বেশ কয়েকদিন পাহারা দিতে রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছিল।
অক্ষয় কুমার মৈত্র এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘হরিনাথ যাহাকে লক্ষ্য করিয়া সুতীব্র সমালোচনায় পল্লী-চিত্র বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন তিনি এদেশের সাহিত্য সংসারে এবং ধর্ম জগতের চির পরিচিত তাহার নামোল্লেখে হৃদয় ব্যথিত হয়, অবসন্ন হইয়া পড়ে।’
সাংবাদিকতা কাকে বলে তা সে দেখিয়ে গিয়েছে। পাবনা কৃষক বিদ্রোহে কলকাতার বিগ হাউস কাগজেরা সোমপ্রকাশ, অমৃতবাজার-এর মত কাগজেরা যখন জমিদারের পক্ষে সে তখন কৃষক বিদ্রোহের পক্ষে একা দাঁড়িয়ে কলমকে তরবারি করে তুলেছে।
সে নিজের তৈরি করেছে ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্র,মীর মোশারফ হোসেন, জলধর সেনের মতো সাহিত্যিকদের। রবীন্দ্রনাথও তার পত্রিকায় কলম ধরেছে।
কৃষ্ণপক্ষকালীন এই সময়ে সংবাদপত্র যখন চরিত্রভ্রষ্ট হয়, দালালির দাসত্বে রাষ্ট্রের পক্ষে মাথা আন্দোলিত করে তখন কাঙাল হরিনাথ– হরিনাথ মজুমদারের কথা মনে পড়ে।
হে সাংবাদিক! কলমের জোর কাকে বলে, দেখো কলম কতদূর যায়….