অবতকের বিশেষ প্রতিবেদনঃ 

বিসর্জনের পরদিন

তমাল সাহা

দুর্গা দালান শুনশান। মেরাপ এখনো খোলা হয়নি। মণ্ডপের ভেতর সাবেকি সামিয়ানাটি এখনো টাঙানো রয়েছে। তবু তার চারদিকের বাঁধন যেন শিথিল হয়ে গেছে বলে মনে হয়। সামিয়ানাটা একটু ঝুলে গেছে্ তার গায়ের রংয়ে বিবর্ণতার ছোঁয়া লেগেছে বোধ করি। লম্বা চওড়া বেদিতলে সে আর নেই। বিশাল শূন্যতা মণ্ডপকে ঘিরে আছে। বেদিতে সারারাত জ্বলেছে একটি বড় পিদিম। দেখি সলতের বুক পর্যন্ত পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। তারপর তার আলোর দহন শেষ। নিথর হয়ে পড়ে আছে প্রদীপের বুকে। চারদিকে একটা শব্দহীন হাহাকার ভেসে বেড়াচ্ছে। বোধ করি একই বিষাদ বলে।

মাটির দিকে তাকাই। মণ্ডপ চত্বরে কাল নারীরা এসেছিল। মাকে বরণ করেছিল পান পাতায়, সিন্দুরে, সন্দেশে। মণ্ডপের মেঝেতে দেখি ছড়িয়ে আছে কিছু সিঁদুরের রং ও সন্দেশ গুড়ো। নারীরা নিজেরা সিঁদুর খেলে রম্যাণি হয়ে উঠেছিল

শহরের নাগরিক হতে এসেছিল মুন্সীগঞ্জের দুই প্রজন্ম পুরুষ। ধান খেতের আল ধরে এক চাষি তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে চলেছিল শিমুরালি স্টেশনের দিকে। তারপর ট্রেনে করে এসেছিল কাঁচরাপাড়ায়। ছেলেটি কাঁসি বাজিয়েছিল বাপের সঙ্গে। বাপ ঢাকী, ছেলে সঙ্গতকার। দেখি চন্ডীমণ্ডপের একপাশে বাপ বেটা শুয়ে আছে। মাথার কাছে রাখা আছে ময়ূরপঙ্খী ঢাক এবং কাঁসিটি। ঢাক বাজানোর চটাকাঠি ও মুঠোকাঠি দুটি, কাঁসি বাজানোর ছোট্ট খণ্ডটি– যন্ত্রের অনুষঙ্গ, ওরাও যন্ত্র দুটিকে ছুঁয়ে আছে।

আমার পায়ের শব্দে ওরা উঠে পড়ে। ওদের সঙ্গে কথা হয়। ঢাকী বলে, বাড়ি তো অনেক দূর। তাই কাল আর বাড়ির দিকে রওনা হইনি। আজ সকালে পাড়ার বাড়ি বাড়ি গিয়ে আগাম আগামনী ঢাক বাজাবো আর কিছু পার্বনি তুলব, জানান দেবো আমরা তোমাদের পাড়ায় এসেছিলাম। তারপর বাবুদের সঙ্গে ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমীর বাজনদারের মজুরি নিয়ে বিকেলের দিকে ছেলের হাত ধরে চলে যাব, বাড়ি।আসছে বছর হয়তো আসবো যদি কিছু না ঘটে যায়!

গৌরী চলে গেছে কৈলাসে।

সিঁদুরে বরণ করে ঘরের নারীরা আরও ঐশ্বর্যময়ী হয়ে ফিরে এসেছে ঘরে। কাল তাদের মুখ সিঁদুরে উজ্জ্বল ছিল। সেই মুখ সাফসুতরোর পর উজ্জ্বলতর কমনীয় হয়ে উঠেছে। তারা বাড়ি ফিরে সিঁদুর খেলার মশগুলে খোশ মেজাজে আছে।

আজ একাদশীর দিন। তাদের মুখে সম্মিলনের কথা শুনি। নারীরা মিলিত হলে কলরব ওঠে।

দুর্গা চলে গেছে। ঘরে ঘরে ছোট উমারা, বড় গৌরীরা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। নীলকন্ঠদের পাশে বসে এই চার দিনের গল্প তারা বলে যায়…..

দুর্গারা এসেছিল পাড়ায় পাড়ায়।

নীলকন্ঠ উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দেয় আর গৌরীর মুখের দিকে তাকিয়ে গল্প শোনে। তার বৈঠকখানা ঘর-লেখার ঘর কৈলাস হয়ে যায়!