কাঁচরাপাড়া-হালিসহর- কল্যাণীতে সমরেশ বসু
১৯৮৮, ১২ মার্চ সমরেশ বসু চলে গিয়েছেন আমাদের ছেড়ে। এই সমরেশ বসু ১৯৪৪-৪৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন। তাঁর উক্তি থেকে জানতে পারি– পার্টি যখন বিভক্ত হয় তার আগেই ১৯৫৫ সালে আমার সদস্য পদ খারিজ– ড্রপড হয়ে যায় নিষ্ক্রিয়তার কারণে।
এই সমরেশ বসুই কখনো সুরথনাথ আবার কখনো বা কালকূট কখনো বা ভ্রমর ছদ্মনাম ব্যবহার করে আমাদের কাছে হাজির হয়েছেন। বিবর ও প্রজাপতি উপন্যাস লিখে বিতর্কিত হয়েছেন, আদালতে হাজিরা দিয়েছেন।অমৃতকুম্ভের সন্ধানে,দেখি নাই ফিরে উপন্যাস লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
কোনোদিন কঠিন কঠোর জীবন সংগ্রামে লিপ্ত মানুষ তিনি, চটকলে কাজ করেছেন। জীবনকে হাতের তেলোর মতো চিনেছেন।
১৯৫৪। সমরেশ বসু আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘শহরতলির পথে’ প্রতিবেদনে কাঁচরাপাড়ার সমীক্ষা লিখলেন। তার মানে তাঁকে কাঁচরাপাড়ায় আসতে হয়েছিল। তিনি পুরসভায়ও গিয়েছিলেন। তখন শাস্ত্রীমশাই চেয়ারম্যান। শাস্ত্রীমশাই মানে রাসবিহারী শাস্ত্রী। শাস্ত্রীমশাই স্বাধীনোত্তর ভারতে কাঁচরাপাড়া পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান। তিনি অঞ্চলের অন্যতম শিক্ষাবিদ ও আঞ্চলিকে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সমরেশ বসু শাস্ত্রীমশাইয়ের ওয়ার্কশপ রোডের সেই বিখ্যাত চেম্বার ‘কবিরাজি আড্ডায়’ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতও করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সোমনাথ ভট্টাচার্য, আরেক সাহিত্যিক। সোমনাথ বাবুর কাঁধে তখন ছিল সেকেলে রেক্সিন ওঠা বক্স ক্যামেরা। শাস্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে তাঁর নগরায়ন বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছিল।
১৯৫৮ সালেও সমরেশ বসু একবার এসেছিলেন কাঁচরাপাড়ায়। সেবার ছিল রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সতীশ নন্দী পাঠশালায়– সতীশ নন্দী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেও ওয়ার্কশপ রোডে। সম্মেলনের আয়োজক প্রগতি পাঠাগার।
প্রগতি পাঠাগার নির্মাণ সে আবার এক আশ্চর্যজনক তো বটেই এই শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস।
খগেন প্রামাণিক, জগদীশ মোদকেরা তখন প্রগতি পাঠাগারের হাল ধরে আছেন। সেদিন তিনি সাহিত্য পাঠের আসরে সভাপতি হয়েছিলেন।
বলতে দ্বিধা নেই, সেই ৭০ দশকের মধ্যভাগের কথা। শ্রীলক্ষ্মী সিনেমা সংলগ্ন তারকেশ্বর বার ছিল। শ্যামনগর থেকে কল্যাণী এই অঞ্চলে এটিই ছিল একমাত্র পানশালা। সেখানেও তিনি
নৈশ-আসবে কয়েক বার মজলিসে এসেছেন।
আর কাঞ্চনপল্লীর ঘোষপাড়া?
সেখানে যে কতবার এসেছেন তার ইয়ত্তা নেই। সতীমার মেলায় বাউলের আখড়া– সেখানে নিজেকে খুঁজে বেড়িয়েছেন আর অনুসন্ধানে মেতেছেন– কোথায় পাবো তারে!
হালিসহরও তাঁর পদধ্বনি শুনতে পেয়েছে। গঙ্গা! ও গঙ্গা! তু বহতা কিঁউ? হালিসহরে আসবো না আর গঙ্গা উপন্যাস লিখবো তা কি হতে পারে!
তিনি আসতেন নিমাইচাঁদ অধিকারীর বাড়ি। মান্নাপাড়ায়। নিমাইবাবু ছিলেন রামপ্রসাদ লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক। তিনি আসতেন জেলেপাড়ায় তাদের বাড়িতে। মেটে দাওয়ায় বসতেন। সেটি ১৯৫৫-৫৮ র ঘটনা। টানা চার বছর। কেন আসতেন? জানতে আসতেন, শিখতে আসতেন, দেখতে আসতেন— জাল কত প্রকার ও কি কি, মাছ ধরার প্রণালী, বাওর কি, মেছুড়েদের নিজস্ব ভাষা, কথা বলার ঢঙ, ভঙ্গি এইসব আর কি! তাঁকে নিমাইবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন যশোদাজীবন ভট্টাচার্য। তিনিও সাহিত্যিক। যশোদাজীবনের বাড়ি ছিল হালিসহরের বারেন্দ্র গলিতে।
তিনি লিখলেন বি. টি. রোডের ধারে– সেখানকার হরেক যাপিত জীবনের কথা। তিনি লিখলেন জগদ্দল– চটকল শ্রমিকদের কথা। তিনি লিখলেন ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’– লড়াকু জীবনের কাহিনী। তিনি লিখলেন ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’– শ্রমিষ্ঠ মজদুর জীবনের কাহিনী। তিনি লিখলেন সংগ্রামী অন্ত্যজ(!) শিল্পী-ভাস্করের জীবন ‘ দেখি নাই ফিরে’।
সেসব কথা রাঙতায় মোড়া পুরানো কথা। সাহিত্যিক হওয়া কি মুখের কথা! সাহিত্যিক হওয়া কি সোজা কথা!