তার জন্মদিন ২৬ জুলাই ,১৯০৪। তিনি চলে গিয়েছেন ৩ সেপ্টেম্বর,১৯৬৯। তিনি বিপ্লবী এবং কমিউনিস্ট নিরঞ্জন সেনগুপ্ত
এইসব মানুষ একদিন কাঁচরাপাড়ায় এসেছিল
তমাল সাহা
এইসব মানুষ একদিন কাঁচরাপাড়ায় এসেছিল। তার জীবন জড়িয়ে গিয়েছিল জনপদের মানুষের সঙ্গে। ভাবা যায়!
স্মৃতির চোখ অনেক দূর মেলে দিতে পারলে মনে পড়ে যাবে তার মশাল জ্বালিয়ে হেঁটে যাবার দিনলিপি, অনুশীলন সমিতি ও সতীশ পাকড়াশির সঙ্গে পরিযায়ী জীবন, ভেসে উঠবে বহরমপুরে ঠাঁই গড়ে মুর্শিদাবাদে বিপ্লবী সংগঠনের কাজ। ল্যাবরেটরিতে প্রাকটিক্যাল ক্লাস করতে করতে তার গ্রেপ্তার হয়ে যাবার মুহূর্ত। মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলখানায় অন্ধকারে বসে সূর্যসেনের সঙ্গে তার কথাবার্তার অগ্নিময় সন্ধিক্ষণ স্মৃতিকে উত্তেজিত করবে।
জেল থেকে ফিরেই তার নিজের হাতে রিভোল্ট গ্রুপ গড়ার কাহিনী এবং বিপ্লবী আন্দোলন ছড়িয়ে দেবার জন্য গোপন ইশতেহার ও যতীন দাসের মৃত্যুতে লিফলেট বিলি ওস্তাদির নৈপুণ্য।
মেছুয়া বাজার বোমা মামলায় ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের চক্রান্তকারী এক নম্বর নায়ক ছিলেন তিনি। পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কলাবাগান বস্তি থেকে সতীশ পাকড়ালশি ও রমেন বিশ্বাসের সঙ্গে। তারা ২৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল একসঙ্গে। ১৯৩০ সাল হয়ে গেল তার ৭ বছরের দ্বীপান্তর। ইতিমধ্যে জেল খাটতে খাটতেই তিনি হয়ে গিয়েছিলেন জেলখোর। জেলঘর দেখা বুঝি নেশা ছিল তার। আলিপুর, মেদিনীপুর, রত্নগিরি, বেলগাও, বক্সা ক্যাম্প, দেউলি-হিজলি— কয়েক ঘরের সমস্ত জানালা দরজা তার মুখস্হ। শেষ পর্যন্ত তার ঠাঁই মিলে ছিল আন্দামান সেলুলার জেলে। ফলে জীবনের মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয় রেড ইউনিভার্সিটি বা মার্কসিস্ট কারখানা,যেখানে গড়ে উঠেছিল কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন। তিনি হয়ে গেলেন কমিউনিস্ট।
বোমার মামলায় অভিযুক্ত এই মানুষটি কলমও ধরেছিলেন। হাত পাঠিয়েছিলেন সাংবাদিকতায়। একদিন ছিলেন যুগান্তর পত্রিকার সাব এডিটর। ছিলেন ১৯৪২ সালে জনযুদ্ধ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ছিলেন।
বীজপুর এক চাঁদকপালে গঞ্জ। পেয়ে গেল তাকে। চলে এলেন কাঁচরাপাড়া- হালিশহর কেন্দ্রীভূত অঞ্চলে। সেটা ১৯৫২ সাল। দুই অস্ত্রবাদী তখন মুখোমুখি শহরে। একজন যখন কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন আরেকজন তখন রূপান্তরিত কংগ্রেসী। রিভলবার মাস্টার বিপিন বনাম বোমবাজ নিরঞ্জনের লড়াই হল প্রথম সাধারণ নির্বাচন বীজপুর বিধানসভা কেন্দ্রে ১৯৫২ সালে। এই বিধানসভা অঞ্চলে প্রচারে এসেছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও বিদগ্ধ বাগ্মী হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এক সময়ে তার পিতৃভূমি ছিল এই হালিশহর। আর এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্পল্ডিং মাঠে কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে জনসভায় কংগ্রেসের হাতে বাঁশের লাঠিতে পেটাই খেয়ে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন কাঁচরাপাড়ার দুই ভাই যুবক বনমালী দাস ও শৈলেন্দ্রনাথ দাস। পরবর্তীতে তারা রেল শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই নির্বাচনে অবশ্য নিরঞ্জন সেন হেরে গিয়েছিলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির কাছে। কিন্তু পরাজিত হননি মননে ও চেতনায়। কাজ শুরু করলেন কাঁচরাপাড়া রেল ওয়ার্কশপের শ্রমিক বেল্টে– ই বি রেলওয়েকে কেন্দ্র করে। কর্মক্ষেত্র আরো বাড়ালেন শিবদাসপুর সালতে জেটিয়ার চাষাভুষো এলাকায় এবং মিলননগর হেলেঞ্চা শহীদনগর বাস্তহীন মানুষের মধ্যে। বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর মৃত্যুতে উপনির্বাচন হল ১৯৫৪। এইবারও হারলেন তিনি কংগ্রেসের মৈত্রেয়ী বোসের কাছে মাত্র ৭৯৫ ভোটে। এই নির্বাচনে প্রচার সভা সার্কাস ময়দানে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন অরুণা আসফ আলি। তিনি ক্রেগ পার্কেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
আগুনখোথ তিনি। আরো তেতে উঠলেন।মিশে গেলেন বীজপুরের জনপদেঋ অস্থায়ী ছাউনি ফেললেন কাঁচরাপাড়া সতীশ নন্দী রোডে। সেই সরল সাদাসিধে তেজবান অমূল্য উকিলের আস্তানায়। কখনো গুরুপদ সেনগুপ্তের বাড়ি, রজনীবাবু রোডে বৌদি সবিতা চ্যাটার্জির টালির ঘরে। কখনো হালিশহরের নন্দ চ্যাটার্জির বাড়ি, কখনো পরিতোষ চক্রবর্তী আশ্রয়ে। টালিগঞ্জে নিজের বসত ছেড়ে এখানেই তখন তার নাওয়া খাওয়া। শেষ পর্যন্ত শেষ দেখে ছাড়লেনৃ ১৯৫৭ সালে কংগ্রেসের রেণু মজুমদারকে ১২০০ ভোটে হারিয়ে জিতে গেলেন বীজপুর কেন্দ্র থেকে। তিনিই বীজপুর কেন্দ্রের প্রথম কমিউনিস্ট বিধায়ক।
পরবর্তীতে তিনি ১৯৬২;এবং ১৯৬৭ সালে টালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার উদ্বাস্তু ও ত্রাণ দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেন।
বীজপুরের আর কি তাকে মনে পড়ে? সেই সত্যিকারের গল্প বা তার চিন্তাজাত কর্মধারা থেকে হয়তো সরে গিয়েছে এই শহর। কিন্তু কাঁচরাপাড়া কলেজ সংলগ্ন নিরঞ্জন সেন পল্লী, হালিশহরের নিরঞ্জন সেন ভবন নামে পার্টি দপ্তরটি তিনি যেখানে কোনোদিন পদার্পণ করেছিলেন,এই স্মারক চিহ্নগুলি ঝাপসা দৃষ্টির মধ্যে এখনো বিদ্যুৎ চমকের মতো শিহরণ তুলে যায়।