অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন

শিব হে! তোমার সঙ্গে গাজনে যাবো

অবতক,১৩ এপ্রিলঃ শিব হে, মাথায় কেন বাইন্ধাছ জটা? সেতো সকলেই জানে গঙ্গা ছিল তার মাথার জটায় আবদ্ধ। আসলে শিব মঙ্গলবাহক। একে বলে এক ঢিলে দুই পাখি মারার দেবতা। গঙ্গার সঙ্গে প্রেমও হলো মানব ত্রাণের জন্য জীবন জলও মর্ত‍্যে আনা হল। এই না হলে শিব!
সে একদিকে শঙ্কর,সে অন্যদিকে নটরাজ। আবার প্রেমে উন্মাদিনী পার্বতী-মেনকা তাকে বলে ভোলানাথ। শিবের এই কৌশল বড়,যে ধরতে জানে না সে কি আর এই জগতের মানুষ হল? শিব কেমন করে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই জগৎ।
তুমি এনেছো গঙ্গা জল,সেই জল তোমার লিঙ্গে ঢালার জন্য,কত নারীর ঢল।

শিব সম্পর্কে গান আছে,ছড়া আছে।আমরা দুটি ভাই,শিবের গাজন গাই। আবার সাংসারিক কথাও আছে,বহু সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। কত কথা,কত প্রবাদ এই শিব নিয়ে। শিব হে!
গাজন মানে শিবের গান। সে এক এলাহি গান। শিব নিয়ে কত কান্ড কারখানা। আমরা জানি শিবের দক্ষযজ্ঞ, শিবের নটরাজ নৃত্য,আর কত কবির কথায় উঠে আসে শিবের গলির কথা।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুলিশের হাতে নকশালকে খুন হতে দেখেন শিবের গলিতে।

আমাদের হালিশহরে শিবের গলি রয়েছে। সেসব বিশাল শিব মন্দির। জোড়া শিবমন্দির। এইসব পুরানো কত কথা। এই শিবের গলিতেই রিভলবার মাস্টার বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি থাকতেন

চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে শিবের ব‍্যাপক প্রচার।
গাজনের উৎসব, সন্ন্যাসীদের রক্তিম বস্ত্র,রক্তিম ললাট,সর্বাঙ্গ লালে লাল। নিম বা বেল কাঠের শক্ত মজবুত কাঠের পাটাতে ত্রিশূল বসানো। সিঁদুরে লেপ্টে তেল শুষে শুষে সে এক অপূর্ব কালিকাময় মূর্তি। শিবের পাটা।সেই মূর্তি লৌকিক সন্ন্যাসীরা কাঁধে করে বয়ে চলেছে।


হর হর ব‍্যোম ব‍্যোম!জয় হে শিব!বলে বাজছে ঢাক। আর তার সঙ্গে গ্রামীণ লৌকিক নস্টালজিয়া অলৌকিকতায় পৌঁছে যাচ্ছে।
সার সার মানুষ মাঠ জুড়ে সোল্লাসে চিৎকার– শিব হে!

সেই আত্মশুদ্ধির গাজন উৎসব এবার জেঠিয়া পঞ্চায়েত গ্ৰামে বিজনার মাঝের পাড়া মাঠে ছেষট্টি বছরে পড়ল। এই কমিটি চালাচ্ছেন সভাপতি কানু সরকার ও অবিনাশ সরকার। যুগ্ম সম্পাদক প্রাণ কুমার বিশ্বাস ও অজিত বিশ্বাস।‌তারা জানালেন দীর্ঘকালের এই পুজো,এই অঞ্চলের ঐতিহ্য। সেই উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি।

সে এক বিশাল মাঠ।গাজনের মেলা। দুশোজন সন্ন্যাস ব্রত নিয়েছেন। কিশোর সন্ন্যাসীও রয়েছেন লাল বা গেরুয়া বস্ত্রে সর্বাঙ্গ ঢাকা। একমাস ধরে হবিষ্যি পালন চলছে। শিব হে তোমার জন্য কত কৃচ্ছ্রসাধন। চড়কের গাছ,মাসের পর মাস ডুবে থাকে জোড়াপুকুর ঘাটে,ভেসে উঠল গাজন উৎসবের সুবাদে। এই উৎসব যোগসাধনের উৎসব। নিজেকে উৎসর্গ করার উৎসব। বিশাল চড়ক কান্ড মাঠের মধ্যে পোঁতা। দড়ি ঝুলছে। দুজন সদ্য যুবক সন্ন্যাস নিয়েছে।পিঠে তিমাথার ত্রিশূল বেঁধানো। মাঠজুড়ে ওয়ার্ম আপ করে চলেছে।তারা চড়কের খেলায় মাতবে। চড়কে ঘুরবে বনবন করে। এ যেন এক বিশ্বজগত প্রদক্ষিণ।

এর আগে একপ্রস্থ খেলা হয়ে গেল। কাঁটায় পরিপূর্ণ, খেজুর গাছের মাথার শীর্ষ দেশে উন্মত্ত নৃত্য। কাঁটা তাদের শরীরে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারল না। বৃক্ষ ঘিরে সন্ন্যাসীদের উল্লাস,হর হর মহাদেব।

তারপর চলল আর এক অদ্ভুত খেলা, দীর্ঘ পরিখাকৃতি অগ্নিকুণ্ডের উপর দিয়ে পদযাত্রা।
সে কী কান্ডরে বাবা! যোগরাজ মহাদেবের সে কি লীলা! যেন তাদের ভর করেছে। এখন গ্ৰীষ্মের দাবদাহ সঙ্গে ভোটের উত্তাপ, লৌকিক উৎসবে এখন ভোট মাতব্বরেরাও ঢুকে গেছে। চলছে উৎসব, গাজনের উৎসব।

আর হালিশহরের কালীবাড়ি মাঠে চড়ক মেলার গাজন উৎসবও হয়েছে। মহিলা মন্ডপ পাড়ার পাঁচজন সন্ন্যাসী চড়ক উৎসব পালন করে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে চড়ক মেলা চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে।

আর শহীদ নগরের শুরুতেই চড়কতলায় ওই মেলা হয়েছে পয়লা বৈশাখে। পয়লা বৈশাখ থেকে দুদিন চলছে চড়ক মেলা। সেইখানেও পোঁতা হয়েছে চড়কগাছ। তাকে ঘিরে চলছে আরাধনা।

আরাধনা কতদূর যায়! জনশ্রুতি বলে ডাঙাপাড়া উৎসবের চড়কগাছ বিখ্যাত সাহাপুকুরে বছর জুড়ে ডুবে থাকলেও চৈত্র সংক্রান্তির দিন নাকি নিজে গুণেই পূজিত হওয়ার জন্য ভেসে ওঠে।

হালিশহরের খাসবাটি এবং শিবের গলিতেও এই গাজন উৎসব হত। মালদহে এই গাজন উৎসবের নাম গম্ভীরা।
বাবা ভোলানাথ গঞ্জিকা সেবন করে গম্ভীর হয়ে থাকেন।তাই তার অপর নাম গম্ভীর। গম্ভীর হয়ে গম্ভীরা গানে তিনি মর্ত‍্যজীবী মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা শোনেন। মানুষের মধ্যে চলে আসেন
আর জলপাইগুড়িতে এই গানকে বলে গমিরা।

আসলে তিনদিনের উৎসব, এই গাজনের উৎসব। সেখানে চলে জীবনের বহুরূপ। কেউ সাজেন শিব গৌরী,কেউ সাজেন নন্দী ভিঙ্গী ভূত প্রেত দৈত্য দানব, কতরকমের সাজ। বাংলাদেশে চলছে এই সংঙ সাজের খেলা। ভণ্ড রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকাণ্ড, জীবনযাপনের কথাও গম্ভীরা গানের মধ‍্য দিয়ে আধূনিক হয়ে উঠেছে।

শিব হে! এই সঙ সেজেই যারা বুঝেছে জীবনের সার।তারাই পেতেছে এই দুনিয়ায় সংসার।
আর নারীরা বলে,কে বলে ঐ অঙ্গ শুধু মেনকা-কন‍্যার?
জল ঢালি, দুধ ঢালি তুমি হও আমার!
হে লিঙ্গরাজ নীলকন্ঠ, কত যে খেল তোমার!

বিঃদ্রঃ লেখাটি বিগত বছর ২০১৯- এ লেখা। এবারই প্রথম প্রকাশিত হলো এবং অপরিবর্তিত রেখে।