আজ কল্যাণী বইমেলার বিদায় সঙ্গীত
এক)
বইমেলার সঙ্গীত
শেষ রোদরশ্মি চলে যায়….
বইমেলার প্রান্তর থেকে তুলে নিই একমুঠি মাটি
সব প্রকাশকদের জানিয়ে প্রণাম
বইয়ের স্কন্ধাবারগুলির পাশ দিয়ে হাঁটি।
বর্ণ থেকে বাণ শব্দটি এসেছে নাকি
তবে বলে কেন শব্দভেদী শর!
শব্দে লুকিয়ে তবে কোন ঈশ্বর–
শব্দের ভেতর থেকে উঠে আসে কোন কন্ঠস্বর?
বোধ ও বোধির বিষয় তো একটাই– মানুষ
আমার মননে বেঁচে থাকুক একলব্যীয় পৌরুষ।
সে ছুড়েছিল শব্দভেদী বাণ
বই তো আমার তার স্কন্ধের তূণের মতো
সেখান থেকে তুলে নিই আগ্নেয় শব্দের তুফান!
দুই)
শৈত্যপ্রবাহ ধীরে ধীরে ছুটে আসে। অন্ধকার নেমে আসে আবহাওয়ায়। মাথার উপর গর্ভিনী আকাশ এক এক করে নক্ষত্ররাজি প্রসব করতে থাকে। রাতের চন্দ্রমা তাদের পাহারা দেয় উজ্জ্বলতায়।
বইমেলার বিশাল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আমি।
দীপগুলি জানে, বিদায় ধ্বনি শোনে
ক্রমে ক্রমে জ্বলে ওঠে বইঘরের ময়দানে।
মনে পড়ে যায়
একলব্যের শব্দভেদী সপ্তশরের কথা।
সে এক স্পর্ধার অনন্য গাথা—
একলব্যের প্রতি
হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে ফেলে দিয়ে
আরণ্যক অন্ধকারে কোন মন্ত্রে জাগাও তুমি?
আর প্রশ্ন তুলে দাও,
শিক্ষায় আবার বর্ণবৈষম্য কি?
জটাজুটধারী বল্কল পরিহিত
হে নিষাদ বালক!
ব্রহ্মজ্ঞানী আচার্যের তাচ্ছিল্যকে উপেক্ষা করেও তাকে তুমি শ্রদ্ধার আসনে বসাও
গুরুকে মর্যাদানের সবক শেখাও আমাদের।
তুমি জনজাতি বনবাসীর গর্বে বলীয়ান।
জন্মের আভিজাত্যে ঋজু বৃক্ষের মতো সটান
থাকো।
কৌন্তেয় কর্ণের মতো হাহুতাশ নেই তোমার।
পরিচয়! পরিচয় আবার কি?
ভূপৃষ্ঠে জন্মেছি, এটাই তো বড় পরিচয়।
সাতটি বর্ণ মিলেই তো রামধনু নির্মাণ!
বর্ণাশ্রমের ধুয়ো তুলে দ্রোণাচার্য কেড়ে নিতে পারে তোমার অধিকার?
উচ্চবর্ণ হতবাক!
অস্ত্রশৈলীর দক্ষতায় অনুপম তুমি।
বায়ুমন্ডল বিদীর্ণ করে ঘোষণা করো জনজাতির জয়যাত্রা।
অরণ্যের অধিকার—
নীরবে-নিভৃতে অস্ত্রবিদ্যা শেখো তুমি একা একাগ্রতায়
অগ্রাহ্য করো বিভেদ বৈষম্য।
মহাভারতের কাল থেকে উদ্ভুত স্বজনপোষণের
বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী তুমি।
একটি ধনুকে কি করে সপ্তশর যোজনা করো তুমি?
এ কোন অপূর্ব অভূতপূর্ব কৃৎ কৌশল!
এ কোন অস্ত্রশৈলীতে সারমেয়ের কন্ঠরোধ অথচ বাঁচিয়ে রাখো তাকে– জীবনের মহিমাকে দেখাও সম্মান!
আর গুরূদক্ষিণা!
সে তো এক উচ্চবর্ণীয় ধূর্তামি!
সে তো জেনে বুঝেই দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙুল করো প্রদান।
ত্যাগব্রতের উচ্চতম পতাকা উত্তোলন করো আকাশে!
নিজের পরিচয়ে জেগে ওঠো
হে হিরন্যধনু পুত্র!
তুমি কোথায় রেখে গেছো সেই অক্ষয় তূণ?
আমাকে শেখাও তুমি বাণ নিক্ষেপর শৈল্পিক সুষমা।
কবিতার পংক্তিমালায় জ্বলে উঠুক শব্দভেদী আগুন।
একলব্যের জন্য কতটুকু আর লেখে ব্যাসদেব দ্বৈপায়ন
গুহক-শম্বুকের জন্য কতটুকু লেখে মহর্ষি বাল্মীকির রামায়ণ!
হে নিষাদ পুত্র!
তুমি আমাকে দিয়ে কেন অঙ্গীকার করাও
বিপুল জনতাকে জাগাও কলমাস্ত্রে
টংকার তুলে করো শব্দ সংযোজন!
সেই শব্দভেদী শর ছুটে যাবে দিক থেকে দিগ্বিদিকে
একটি শব্দ উচ্চারিত হতে থাকবে অনুক্ষণ।
একটি শব্দ বিস্তৃত হবে চরাচরে
মানুষ! মানুষ! উচ্চারণ।