কাঁচরাপাড়া হকার্স কর্নার ও ঝুলনযাত্রাঃ একটি জীবন সংগ্রাম ও লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রজ ইতিহাস
তমাল সাহা
নাক উঁচু মানুষদের কাছে ‘হকার’ শব্দটি তাচ্ছিল্যের উচ্চারণ। কিন্তু কাঁচরাপাড়ার ছিন্নমূল হকাররাই দেখিয়ে দিয়েছিল ‘হকার শিল্প’ এবং লোকসংস্কৃতির যৌথ সমন্বয় গড়ে তুলতে পারে একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক বনিয়াদ। কাঁচরাপাড়ার ঝুলন উৎসবের সঙ্গে একদা ওপার থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষের শ্রম ও সংগ্রাম জড়িয়ে রয়েছে।
এখন যেখানে মাকালী ফ্যাশন, আগমনী, ভারত সু-র বিশাল বিল্ডিং সে জায়গাটি ছিল শ্রীদুর্গা সিনেমা হলের কর্ণধার অতুলচন্দ্র পালের দীর্ঘ পুকুরের পারবর্তী অঞ্চল। বর্তমানে পুকুরটির নামমাত্র চিহ্ন রয়েছে। বেআইনিভাবে তা দখল হয়ে গিয়েছে।
এই পুকুর পারেই স্বাধীনতার পরবর্তীতে উদ্বাস্তু মানুষজন পসরা নিয়ে বসতো। কার্বাইডের গ্যাস বাতিতে তখন দোকান আলোকিত হতো। ব্রিটিশ চলে গেলে কি হবে, পুলিশের হুকুমদারি তখনও বিন্দুমাত্র কমেনি। তখনও হকারদের পুলিশকে দিতে হতো ‘নজরানা’। এখন আপনারা যাকে তোলা বা হিস্যা বা বখরা বলেন, এখন এর আধুনিক ব্যঞ্জনা বিধৌত হয়ে আছে ‘কাটমানি’ শব্দটির মধ্যে। বখরা দিলেও আবার লোকদেখানো হল্লা গাড়ি আসতো। কিছু ধরপাকড় হতো। আবার ছেড়েও দেওয়া হতো। মানে ‘গট আপ’ কেস।
তবে তখন দাদা তোলাবাজি বা রাজনৈতিক তোলাবাজরা ছিল না।
শেষ পর্যন্ত এই প্রশাসনিক তোলাবাজির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন সীমান্ত পেরিয়ে আসা ‘হকার’ অসিতারঞ্জন দত্ত, হরিদাস দে, সীতানাথ ঘোষ, প্রভাত চন্দ্র মন্ডল, জীবন দাস, চিত্ত নাথ, দেবেন্দ্র চন্দ্র নাথ, হীরালাল নাগ, জিতেন বিশ্বাস, ক্ষেত্রমোহন নাথ, রাখাল দে, নলিনী পাল, শ্যামল মন্ডল প্রমুখ লড়াকু হকাররা। তৈরি হলো মজবুত সংগঠন।
বীজপুরের প্রথম বিধায়ক বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি ও পৌরসভার প্রথম পুরপ্রধান রাসবিহারী শাস্ত্রী বাড়িয়ে দিলেন সহযোগিতার হাত। গড়ে উঠলো হকার্স ইউনিয়ন। সেটা ১৯৫২ সাল। সভাপতি হলেন নরেন দে। সম্পাদক নির্বাচিত হলেন বিনোদ রাহা।
জমিদার অতুল চন্দ্র পালের সঙ্গে আলোচনায় বসলো হকার্স ইউনিয়ন। মদত দিলেন তৎকালীন এসডিও দত্ত সাহেব। আলোচনা কয়েকবার ভেস্তেও গেল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো গুমটি তৈরি করে দেওয়া হবে। এসডিও সাহেবের সৌজন্যে সিমেন্ট ও করোগেটেড টিনের ব্যবস্থা হলো। পুরন সিংয়ের কাঠগোলা ও গুরুদ্বোয়ারার গেটের উল্টোদিকে গড়ে উঠলো ৯ ফুট বাই ৬ ফুটের বেশ কিছু দোকান ঘর। পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেয়াল। মাথায় টিনের ছাউনি। মাঝখানে ক’টি সারিতে তৈরি হলো চাটাইয়ের আরো কটি গুমটি। প্রায় ১০০টি দোকান ঘর।
ইটের দেয়ালের ঘরগুলোর মাসিক ভাড়া ছিল ১০টাকা আর দরমার ঘরগুলোর মাসিক ভাড়া ছিল ২ থেকে ৫ টাকা। কেরোসিন ল্যাম্প আর কার্বাইডের বাতি জ্বলতো তখন দোকান ঘরগুলোতে।
এখন যেটি মূল প্রবেশদ্বার সেটি ছিল দুপেয়ে রাস্তা। পুকুরের জল তখন ছুঁয়ে যেত এই পায়ে চলা রাস্তার মাটি। ফাঁক ফাঁক করে একটা একটা ইট পেতে কোনমতে পা ফেলে হেঁটে যেতে হতো যাতে এ রাস্তাটুকু দিয়ে যেতে পায়ে জল না লাগে। তাই নাম হলো দু-পেয়ে রাস্তা।
কিন্তু দোকান তো হলো, রুটি- রুজির ব্যবস্থা তো করতে হবে! চাই প্রচার। ব্যবসায়ের সঙ্গে মানুষের সংযোগের জন্য ভাবনা শুরু করলো কমিটি।
একদিন আলোচনায় বসা হলো। কী করা যায়! কী করা যায়! কেউ ঠাহর করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত কে একজন হাই তুলে বলে উঠলো ‘জয় রাধে কৃষ্ণ’!ব্যাস! সূত্র পাওয়া গেল। একজন বলে উঠল ঝুলনযাত্রা করলে কেমন হয়! কমিটি খুঁজে পেল রাস্তা। ঠিক হলো প্রতি বছর ঝুলন মেলার আয়োজন করা হবে।
বেশিরভাগ উদ্বাস্তু হকারই ছিলেন বৈষ্ণব। সুতরাং জয় শ্রীকৃষ্ণ,জয় শ্রীরাধে-র উপর আর কথাই ওঠে না।এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হকার্স কর্ণার মার্কেট প্রতিষ্ঠার সংবাদ পৌঁছে গেল হালিসহর, নৈহাটি অন্যদিকে মদনপুর, শিমুরালি, গয়েশপুর, জাগুলি, হরিণঘাটা অঞ্চলে। এই অঞ্চলে তখন এই ঝুলনমেলাই প্রথম।
এবার গড়ে উঠলো ঝুলনমেলা কমিটি। সভাপতি নির্বাচিত হলেন অসিতারঞ্জন দত্ত। আর সম্পাদক হলেন চিত্তনাথ। একদম প্রথম দিকে
ঝুলনমেলার সাতদিনের লিজ দেওয়া হতো। তার দায়িত্ব পেতেন হকার্স কর্নারেরই কোনো ব্যবসায়ী।
হকারদের প্রচেষ্টায় যে ঝুলনযাত্রা শুরু হয়েছিল তা কাঁচরাপাড়ার জীবনে এক লৌকিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সাতদিন ধরে চলে এই মেলা। অঞ্চলের ও বহিরাগত মানুষদের রুটি-রুজির জায়গা করে দিয়েছে এই ঝুলন মেলা।
এই মেলার মূল কারিগর ছিলেন বীজপুরের প্রথম বিধায়ক কংগ্রেস নেতা বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি, রাসবিহারী শাস্ত্রী এবং অন্যান্য উদ্বাস্তু নেতা এবং সমাজকর্মীরা। এই হকার্স কর্ণারের মূল ফটকের উপরে যে বিশাল টিনের সাইনবোর্ড ছিল যেটি এখন নেই, সেখানে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি প্রতিষ্ঠিত হকার্স কর্ণার সমিতি এটি উল্লেখ ছিল। বর্তমানে সিমেন্টে তৈরি মূল ফটকে তাঁর নামের উল্লেখ রয়েছে উল্লেখ্য কাঁচরাপাড়া পৌরসভা ভুলে গিয়েছে রিভলভার মাস্টার অগ্নিহোত্রী এই মানুষটির নাম। বাম বা ডান কোনো রাজত্বকালেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারলো না এই নামটি। কাঁচরাপাড়া পৌরসভায় তাঁর কোনো প্রতিকৃতি নেই! কিম আশ্চর্যম! বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি।
এই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যের বিস্তার, ব্যাপক মানুষের সমাগম, এবং মানুষকে মনোরঞ্জন করা। পরিস্থিতি তখন এমনই ছিল। এমনিতে বাঙালি মনস্কতা সাধারণভাবে একটু ধর্মভীরু বৈষ্ণব প্রধান। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি তার একটি আনুগত্য রয়েছে, ভালোবাসা রয়েছে। যুক্তিতর্ক বিষয়ে আমি যাচ্ছি না। রামায়ণ মহাভারতের বহু খন্ডচিত্র এই মেলায় পরিদর্শিত হতো মাটির মডেলের মাধ্যমে। জন্মাষ্টমী ছিল বাধ্যতামূলক, কংসের অত্যাচারের মডেল, কৃষ্ণের গোচারণ, রাধাকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা। যৌবনের সন্ধিক্ষণে মানুষের মধ্যে যে একটা জৈবিক তাগিদ সেটা আমরা অনুভব করতাম সেই শ্রীকৃষ্ণের বস্ত্রহরণ লীলা দেখে। ওইখানে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতো। জলমগ্ন সখীরা রয়েছে, ঊর্ধ্বাঙ্গ প্রায় অনাবৃত।কৃষ্ণের কাছে বস্ত্র প্রার্থনা করছে, ওপরে কৃষ্ণ বস্ত্র নিয়ে বসে আছে সেই কদম গাছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এটি খুব আকর্ষণীয় ছিল৷ ছিল পুতনা বধ। ওই বিশাল রাক্ষসীর ওই বিশাল স্তন কামড়ে তাকে হত্যা করছে ওই ছোট্ট গোপাল কৃষ্ণ। এটি দেখবার মতোছিল।ছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, কর্ণের রথের চাকা বসে যাওয়া, আত্মসমর্পণ, ওইদিকে শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুন, ভীষ্মের শরশয্যা,সীতার অগ্নিপরীক্ষা সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য!
এ সমস্ত দৃশ্য তখন সুন্দর ভাবে দেখানো হতো। পরশুরামকে দেখানো হতো। নন্দনকাননে সীতা, হনুৃমানের লঙ্কাদহন, এবং বিশল্যকরণী আনয়ন– ফি বছর এ সব দেখে দেখে আমাদের রামায়ণ- মহাভারতের ঘটনা জানা হয়ে যেতো।
পরবর্তীতে একটু আধুনিক যুগ যখন এলো, যখন ওই সরু কাটিং-এর প্যান্ট এলো, তার আগে এলো হাওয়াই চটি,ঐ যে লুকিয়ে পার্কে প্রেম
— ‘আধুনিক’ শিরোনাম দিয়ে একটি মডেল তৈরি করা হতো। প্রেমরত যুবক-যুবতী, প্রেমিকা সিগারেট খাচ্ছে এমন সমস্ত দৃশ্যের মডেলও ছিল।
এখন এইসব মডেল অন্য পর্যায়ে চলে গিয়েছে। জীবন যন্ত্রণার যুগে মানুষও মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন বেশিরভাগ যে মডেল হকার্স কর্ণারে দেখানো হয় সেগুলো জীবন্ত মডেল। তারা প্রায় বিকেল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত স্থির হয়ে সেই মডেলের ভূমিকা পালন করেন। কেউ রামকৃষ্ণ, কেউ মহাদেব, কেউ বা লালন ফকির এবং অন্যান্য মডেল তো রয়েছেই। এই জীবনের সঙ্গে শ্রম, মেলা একাকার হয়ে গিয়েছে এইখানে। ফলতঃ এই মেলা দর্শন একটি জীবনের অভিজ্ঞতা বলেই মনে হয়। রুটি- রুজি- পেট- মেলা- দর্শকদের সঙ্গে সংযোগ, অদ্ভুত এক সহাবস্থান এই কাঁচরাপাড়ার ঝুলন মেলায় দেখা যায়।
আজ যে কাঁচরাপাড়া বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, আকাশচুম্বী অসংখ্য শপিং মল গড়ে উঠেছে বা উঠছে এর অন্তরালে যে বাণিজ্যিক চেতনা রয়েছে তার নিশ্চিত জোগান দিয়েছে এই হকার্স কর্নার। আর এই ঝুলন মেলাই
কাঁচরাপাড়ায় সূচনা করে দেয় শারদের আগমনী। বিশ্বের বৃহত্তম লৌকিক দুর্গোৎসবের বেচাকেনাও শুরু হয়ে যায়।
ঝুলন মেলায় অপ্রকাশ্য রাজনীতিরও প্রাধান্য ছিল। ২০১৮ সালের ঝুলন মেলায় উদ্বোধক নিয়ে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল।
ঝুলন মেলায় অপ্রতিরোধ্য ভাবে রাধাকৃষ্ণ ঝুলবে। কিন্তু মহাভারতের যুগ শেষ।এই সংসদীয় ভারতবর্ষের মসনদীয় দোলনায় কোন রাজনৈতিক দল কখন কিভাবে ঝুলবে তা মহারণ বিশারদ আবিশ্ব মহাকৌটিল্য ময়ূরপেখম রাজ বংশীবাদক শ্রীকৃষ্ণও বলতে অপারঙ্গম।