অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ
ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় জন্ম-মৃত্যুদিনঃ শ্রদ্ধা

অবতক খবর, ১ জুলাইঃ মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। কতসব কথা লেখা থাকে কাঁচরাপাড়ার ইট কাঠ পাথরের দেয়ালে। সময় চলে যায় কথা পড়ে থাকে। কাঁচরাপাড়ার জীবন, সংগ্রামের জীবন, শ্রমের জীবন, লড়াইয়ের জীবন।

কাঁচরাপাড়ায় একজন মানুষ ছিলেন। শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনকে তিনি শুদ্ধ করেছিলেন। ধুতি চাদরের সারল্য ছিল তাঁর পোশাকে। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ। কাঁচরাপাড়ায় বিভিন্ন ইস্কুলের বনিয়াদ গড়ার পেছনে তাঁর নির্মাণ কারিগরি হাত কেউ ভুলবে না। তিনি ছিলেন প্রাজ্ঞ একজন মানুষ। তাঁকে অঞ্চলের শিক্ষাবিদ বলা যায়।
তিনি হার্ণেট ইস্কুলেরও শিক্ষক ছিলেন। মিউনিসিপ্যাল পলিটেকনিক হাই স্কুল তো তিনি গঠন করেছিলেনই তিনি সেখানে শিক্ষকতাও করতেন।

ধন্বন্তরী, ঋষি চরক ও ঋষি সুশ্রুতের অবদান ভারতবর্ষে কে না জানে? জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ তিনি আয়ুর্বেদকে করেছিলেন জীবনের আশ্রয়। “কবিরাজ” আর “আয়ুর্বেদ রত্ন” এ ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। ওয়ার্কশপ রোডে তাঁর কবিরাজি দোকান। সামনে টেবিল চেয়ারে বসে থাকতেন তিনি। কালো চশমা, মাথা নিচু টেবিলের দিকে, শিথিল হয়ে এসেছে ফর্সা ত্বক, চিবুক বসে গেছে — এই ছবি আমার দেখা, চেনা পোট্রেইট।


সংস্কৃত শাস্ত্রে তাঁর প্রাজ্ঞতা ছিল কিংবদন্তী। ‘কবিরত্ন’ মুকুট পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রাথমিক ইংরেজি শিক্ষার বইটি অতুলনীয়। তিনি আর কেউ নন, তিনি রাসবিহারী শাস্ত্রী। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে কাঁচরাপাড়া পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান।

পানীয় জলের কষ্টে ভুগছে কাঁচরাপাড়ার মানুষ। রেলের সঙ্গে লড়াই চলছে কাঁচরাপাড়া শহরের নাগরিকদের জল প্রদানের জন্য। তিনি তো নাগরিক পরিষেবায় এসছেন। এসেছেন জনসেবায়। দায়িত্ব তাঁর।

দীর্ঘদিবের প্রচেষ্টা, লড়াই, আবেদন, কাতর নিবেদন তিনি করেছিলেন কাঁচরাপাড়ায় পানীয় জল সরবরাহের জন্য রাজ্য সরকারের কাছে।

চিঠিপত্রে কি সব কাজ হয়? ঐ যে একটা দরখাস্ত বলে শব্দ আছে না ! খালি দরখাস্ত করো, দরখাস্ত করো। সেই দরখাস্ত লাল ফিতের বাঁধনে আটকা পড়ে যায়। সম্মুখ লড়াইয়ে প্রস্তুত হলেন রাসবিহারী শাস্ত্রী। তিনি বললেন, কাঁচরাপাড়ার মানুষকে পানীয় জল দিতে হবেই। রীতিমতো ওয়াদা করলেন। বারবার আবেদন যখন ব্যর্থ হলো তখন তিনি মুখোমুখি রণাঙ্গনে সৈন্য শিবির সাজালেন। ওয়াটার ওয়ার্কসের অর্থাৎ পাইপলাইন বসানোর কাজের জন্য তিনি মুখোমুখি হলেন বিধান রায়ের। সঙ্গে নিলেন বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি,পিছড়ে বর্গের নেতা বিনোদ বিহারী মল্লিক, উদ্বাস্তু নেতা ফণিভূষণ মজুমদার আর বিহারি নেতা শুভ নারায়ণ দুবেকে।

সোজাসুজি হাজির হয়ে গেলেন রাইটার্স বিল্ডিং এ। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। মুখ্যমন্ত্রী কে? বিধানচন্দ্র রায়। যে বিধানচন্দ্র রায়ের দাপটকে ভয় পেতেন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সেই বিধান রায়ের সামনে গিয়ে তিনি বসলেন।

এই যে তিক্ততাময় ইতিহাস সেটি রাসবিহারী শাস্ত্রী ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে পৌরসভা থেকে প্রকাশিত একটি বিশেষ পুস্তিকায় “কাঁচরাপাড়া মিউনিসিপালিটিতে পানীয় জলের জন্মকথা” শিরোনামে বিবৃত করেছেন। তিনি কি লিখেছেন?
তিনি লিখেছিলেন— “দু চারজন নয়, হাজারে হাজারে নরনারী এক গ্লাস জলের জন্য ভাঁজা দিয়েছে। সমগ্র শহরে তখন আটটি কল, তারই পাশে এই ভিড়। মাঝে মাঝে কলহ, কখনও রক্তারক্তি। বছরের পর বছর একই অবস্থা। স্বাধীনতা লাভের পর বাস্তুহারা শরণার্থীর আগমনে জলাভাব চতুর্গুণ বেড়ে যায়। কারণ পৌরসভার জন্মলগ্নে রেলের শতকরা ৯০ জন মজদুর কোয়ার্টারের অভাবে জল বহির্ভূত ৩ নং ওয়ার্ডে বাস করেন। লোকসংখ্যা ১৫ হাজার।

কাজেই ১৯১৯ সাল থেকে রেলের কাছে জলের জন্য নিষ্ফল আবেদন শুরু হয়। ১৯৩৮ সালে দুটি জনসভায় পৌর কর্তৃপক্ষের নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং আনন্দ বাজার পত্রিকায় সে বিষয়ে একটা প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। পৌর জনগণের এই বিক্ষোভ নিয়ে তৎকালীন সাহেব, চেয়ারম্যান রুষ্ট হয়ে “I resign, I resign” বলতে বলতে সভা ত্যাগ করেন।

১৯৪৭ সালে রাসবিহারী শাস্ত্রী চেয়ারম্যান হওয়ার পর বস্তাপচা ফাইল থেকে সাত বছর আগে লেখা রেল ম্যানেজারের প্রতিশ্রুতি পত্র উদ্ধার করা হয়। ১৯৪৮ সালের ৭ জানুয়ারি তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার শ্রী ডি. নীলকন্ঠনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীদের সঙ্গে জেনারেল ম্যানেজারের তুমুল বিতর্ক হয়। অবশেষে তিনি দশ দিনের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার পাঠিয়ে একটা ব্যবস্থা করতে স্বীকৃত হন।”

এরপরেও অনেক ঘটনা রয়েছে। “অবশেষে জেনারেল ম্যানেজারের কৃপায় ওই মাসেই বিভিন্ন পল্লীতে কল সংখ্যা বেড়ে ৮টি থেকে বাড়িয়ে ১৯ টি করা হয়।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলিকে সঙ্গে নিয়ে শাস্ত্রীমশাই, মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করে কাঁচরাপাড়ার জলের সমস্যার কথা জানান। দু চার মিনিট তাঁর কথা শুনেই ডাঃ রায় পরামর্শ দেন রেলের পিছনে না ছুটে স্বতন্ত্র ওয়াটার ওয়ার্কস করতে এবং পরামর্শ দিলেন এ ব্যাপারে ঋণ নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে।”
শাস্ত্রী মশাই স্পষ্ট জানালেন তিন মাস আগেই তিনি এই ঋণের জন্য দরখাস্ত দিয়েছেন। কিন্তু উত্তর পাননি। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর মুখের ওপর এই কথা বললেন। বিধান রায় সেক্রেটারিকে ডেকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। সেক্রেটারি জানালেন, আপনার নামে দরখাস্ত, আপনার ফাইলেই আছে। এ কথা শুনে শাস্ত্রী মশাই চড়া সুরেই বললেন, “এখানে আমাদের দরখাস্ত আপনাদের ফাইলে পড়ে পচুক আর ওখানে লোকগুলো এক গ্লাস জলের জন্যে মাথা ফাটাফাটি করে মরুক।”

শাস্ত্রী মশাইয়ের মুখে এরকম কথা শুনে সোজা হয়ে বসলেন ডাঃ রায়। এবং বললেন, যে তার চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ডিসেন্ট্রালাইজড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম আছে। ওই অনুসারে জলকল হবে। কিন্তু পল্লীতে জলকরের পরিমাণ খরচ ইত্যাদি সম্পর্কে প্ল্যান দরকার। চিফ ইঞ্জিনিয়ার এলেন। জরিপ, প্ল্যান, স্কিম রিপোর্টও তিন মাসের মধ্যে হলো। খরচ হবে তিন লক্ষ চুয়াত্তর হাজার একশো টাকা। পৌরসভায় তা পাশ করে নিয়মতন্ত্রের মাধ্যমে তা তৈরি হলো। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় ২৬ শে নভেম্বর লিখে পাঠালেন, “টাকা নেই, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।”

১৯৫০ সালের মার্চ মাসে বর্ধিত হারে চার লক্ষ কুড়ি হাজার ছশো পঞ্চাশ টাকার স্কিম হাতে নিয়ে আবার সাক্ষাৎ করলেন শাস্ত্রী মশাই।
ঐ বছরই জুন মাসে তিনি প্রতিদিন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলিকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় যাতায়াত শুরু করেন। এতো কষ্টের পর এক সপ্তাহ পরে একদিন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানালেন, টাকা নেই। তারপর হঠাৎ তাঁর কাছ থেকেই এ্যাড হক কমিটির অনুমোদন পত্রটি নিয়ে “আদেশ” লিখে নিজের ফাইলে রেখে দিলেন। অতঃপর বিভাগ-উপবিভাগে অবিরাম ধর্ণার পর অনেকের সহযোগিতায় জলাভাবের একটা কিনারা হলো।

শাস্ত্রী মশাই, পন্ডিত মানুষ। দাবার ঘুঁটির চাল জানেন। তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন চার উপযুক্ত নেতা। মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরবেন।
প্রথম পর্বে বিধান রায়ের সঙ্গে শাস্ত্রী মশাই তাঁর চার নেতাকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। বিধান রায় আলোচনায় শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, “শাস্ত্রী মশাই! সর্বস্তরের নেতাদেরই যখন আমার কাছে হাজির করে ফেলেছেন তখন আপনার আবেদন আর না মঞ্জুর করে উপায় কি?” এই বলেই বিধান রায় একগাল হেসেও ফেলছিলেন।

কিন্তু মাস যায়, জলের পাইপ আর আসে না। তিনি আবার সদলে চলে গেলেন সেই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। শাস্ত্রী মশাই বললেন, “মুখ্যমন্ত্রী মশাই! আপনি তো জলের আদেশ দিলেন, মাস তো চলে গেল, পাইপ তো গেল না। পাইপ না গেলে, জল যায়?” বিধান রায় তক্ষুনি ডেকে পাঠালেন আমলাতন্ত্রের লাল ফাঁসদের। — কি! কাঁচরাপাড়ায় পাইপলাইন যায়নি কেন? –না। স্যার শীঘ্রই যাবে
বিধান রায় বললেন, আজই যাবে তো?
— আজই যাবে।
বিধান রায় আশ্বাস দিলেন রাসবিহারী শাস্ত্রীকে। ফিরে এলেন তিনি তাঁর সঙ্গী নেতাদের নিয়ে।

সন্ধ্যে হয়ে গেছে তখন। কাঁচরাপাড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে দূর থেকে শাস্ত্রী মশাই দেখলেন, পুরভবন আলোয় আলোময়।
— কি ফণী! ব্যাপার কি? এত আলো জ্বলছে? শাস্ত্রী মশাই মজা করে বললেন,”হয় পাইপ এসে গিয়েছে, না হয় পুরভবনে আগুন লেগেছে। চলো তো দেখি!”
শাস্ত্রীমশাই ফণিভূষণ মজুমদারকে নিয়ে স্টেশন থেকে চলে এলেন পুরভবনে। এসে দেখলেন লরি থেকে পাইপের পর পাইপ নামছে এই রাতের বেলা। তাই এত আলো। রাসবিহারী শাস্ত্রী, ফণিভূষণ মজুমদার, সুবোধ চ্যাটার্জী প্রমুখের প্রচেষ্টায় এসে গেল পাইপ। ফলতঃ কাঁচরাপাড়ার মানুষের পানীয় জল সরবরাহের একটি সুব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেল।

বিধান রায় কাঁচরাপাড়ার মানুষের জন্য এই জলপ্রদানের প্রক্রিয়াটিকে তরান্বিত করেছিলেন।

বিধান রায়ের জন্যই আমাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল কল্যাণী শহর গড়ে উঠেছে। কল্যাণী শহর পত্তনের মূল ভূমিকায় ছিলেন তিনি। কল্যাণী, এই শহরটি তাঁর মানসকন্যা বলে পরিচিত পেয়ে গেছে। কাঁচরাপাড়া-কল্যাণী লাগোয়া লাইভ স্টক ফার্ম- ফডার ফার্ম, কাঁচরাপাড়ার অনতিদূরে হরিণঘাটা পশুপালন ও দুগ্ধ প্রকল্প কেন্দ্রের নির্মাণ হোতা কে?বিধানচন্দ্র রায় গো, বিধানচন্দ্র রায়।

তবে কি তাঁর জীবনে কোনো কলঙ্কময় ঘটনা নেই? দুনিয়ায় কোন মানুষ নিখুঁত? তাঁর রাজত্বকালে ৩১ আগস্ট,১৯৫০-এর খাদ্য আন্দোলনে প্রতিবাদী শতাধিক বুভুক্ষু মানুষকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পুলিশ। এটি ছিল স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক আন্দোলন।
তবে একথা অস্বীকার করার জো নেই, বিধানচন্দ্র রায় পাশে এসে না দাঁড়ালে সত্যজিৎ রায়, সত্যজিৎ রায় হয়ে উঠতে পারতেন না। ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের পেছনের গল্প, কাহিনী, বাস্তব উপাখ্যান কে না জানে?
আর চিকিৎসক? সে তো আর এক কিংবদন্তি! দিল্লিতে গেলেই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁকে দিয়ে প্রেসক্রাইব করিয়ে নেবেনই।
আমাদের অহংকার এইখানে তাঁর জন্মদিনটি ‘জাতীয় চিকিৎসক দিবস’ হিসেবে সম্মানিত।

কংগ্রেস অধিবেশন হয়েছিল ১৯৫৪ সালে কল্যাণীতে। ১৯ জানুয়ারি বিকেলে কাঁচরাপাড়া এরোড্রোমে এসে পৌঁছেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। তাঁকে স্বাগত জানিয়ে তাঁর সঙ্গে একই জিপে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অতুল্য ঘোষের সঙ্গে তিনি এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। সেই যাত্রা বনগাঁ রোগ, থানা মোড়, ওয়ার্কশপ রোড, গান্ধী মোড় হয়ে কল্যাণী অধিবেশন স্থলে পৌঁছে যায়।
পরবর্তীতে ১৯ জুন,১৯৫৯ শিবানী হাসপাতালের পরিষেবা পরিদর্শনে আসেন।

কাঁচরাপাড়ার মানুষ তাঁকে দেখেছে। সে এক পুরানো অতীত অধ্যায়।