অবতক-এর শ্রদ্ধা
নেপথ্য কাহিনীঃ
কিভাবে কাঁচরাপাড়ায় এসেছিলেন উত্তমকুমার
তমাল সাহা
৩রা সেপ্টেম্বর ১৯২৬ উত্তম কুমারের জন্মদিন আর ২৪ জুলাই ১৯৮০ তাঁর প্রয়াণ দিবস। বাংলা চলচ্চিত্রে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই মহানায়ককে কিভাবে আনা হয়েছিল কাঁচরাপাড়ায়, জানিয়েছিলেন মৃণাল সিংহ রায় (আবু-দা)।
আবু একসময়ে নকশাল করত,ফলে শরীরে উত্তেজনা এবং মননে তেজ তাঁর স্বাভাবিক ছিল। তখন তাঁর আড্ডা ওয়ার্কশপ রোডে দশকর্মা ব্যবসায়ী খ্যাত পাঁচু সাহার জামাই মাধব চন্দ্র সাহার দোকানে। মাধব বাবুর ছেলে গৌরের সঙ্গে তখন তাঁর জম্পেশ বন্ধুত্ব।
পরে আবু কংগ্রেসী হয়ে যায়। কংগ্ৰেসের বিমল দত্তের বিরোধী গোষ্ঠী আবু। আবু শুনল ভারতী সংঘ জলসা করবে,হবে বিশ্বজিৎ নাইট। বম্বে থেকে আসবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর এই পরিকল্পনার পুরোভাগে আছে বিমল দত্ত। ব্যাস! খাড় খেয়ে গেল আবু। আবুর মাথায় উঠে এলো পাল্টা প্রোগ্ৰাম। ঠিক হল ডাঙ্গাপাড়া বিবেকানন্দ স্কুলের উন্নতিকল্পে হবে ফাংশান। ‘খাড় খাকে আবু বন গয়া ক্ষুদিরাম’।
বোমা ফাটাতেই হবে। তাঁর সবসময় চাই হাই প্রোফাইল। প্রস্তাব নেওয়া হল এবং ঘোষণা করা হয়ে গেল উত্তম কুমার আসবে। যোগাযোগ হল না, চুক্তি হল না,তার আগেই পড়ে গেল ব্যানার। বিশেষ অতিথি– উত্তম কুমার।
সেই সময় বাবু মজুমদার আবুর এক সাগরেদ। ওঁর বাবা কাঁচরাপাড়ার এক সময়কার সুপরিচিত সঙ্গীতশিল্পী মদন মজুমদার। বাবু বাবুর শিল্পী জগতে অনায়াস যাতায়াত। তিনি সঙ্গীত শিল্পী সুবীর সেন,পিন্টু ভট্টাচার্য্য, হৈমন্তী শুক্লা,বনশ্রী সেনগুপ্ত,হিমাংশু বিশ্বাস– এমন সব শিল্পীর স্নেহধন্য। পিন্টু ভট্টাচার্য্য বাবু বাবুকে প্রোগ্ৰাম অ্যারেঞ্জার অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমেই আবু এবং বাবু বাবু উত্তম কুমারের সেক্রেটারির কাছে সরাসরি ধর্না দিল। উত্তম কুমার হাতজোড় করে বললেন,”সঙ সেজে মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে লোকের কাছ থেকে পয়সা নেবো, সে আমার দ্বারা হবে না ভাই। আপনারা যান।”
এবার ধরা হলো বুড়োদাকে, তরুণ চ্যাটার্জীকে। তাও ফেল। এদিকে আবু ধরল সোমেন মিত্রের মাধ্যমে কলকাতার সেই প্রখ্যাত ফাটাকেষ্টকে। আবুর ফাটাকেষ্ট এবং বাবু বাবুর পিন্টু ভট্টাচার্য্যের মেলবন্ধনে অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়ে গেল। দশ হাজার টাকা আগাম দেওয়া হল অজয় বিশ্বাসকে।
আবু সেই সময় আরেকজনের পরম ভক্ত হয়ে উঠেছে। নৈহাটির আচার্য্য হরিপদ গোস্বামীর। হরিপদ গোস্বামীর আরেক নামজাদা শিষ্য শ্যামল মিত্র। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। আবু আচার্য্য গোস্বামীর কাছে তখন প্রায়শই যেত। তাঁকে সবকথা খুলে বলল আবু,’ গুরুদেব! উত্তমকুমার যে রাজি হচ্ছে না’।আচার্য্যদেব বললেন,”এবার যা হয়ে যাবে।”
দোলের পরদিন যাওয়া হল উত্তম কুমারের কাছে। আগের থেকেই প্ল্যান করা হল অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে। আবীর নেওয়া হবে আর মিষ্টি ও ভ্যাট ৬৯-এর একটি বোতল। মিষ্টি ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন দে-র পুত্র গোবিন্দ দে-র আবার আর্টিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার খুব শখ। গোবিন্দ বলল, ‘আবু আমি তোমাদের সঙ্গে উত্তমকুমারের বাড়ি যাবো’। গোবিন্দদা নিজেই কিনে ফেলল ভ্যাট ৬৯-এর বোতলটি। নিজের হাতে উত্তমকুমারকে তুলে দেবে উপহার।
অজয় বিশ্বাস,আবু,বাবু এবং গোবিন্দ চলল উত্তম কুমারের বাড়ি। অজয় বিশ্বাসের সে কি অভিনয়! ঘরে ঢুকেই উত্তম কুমারের পায়ে আবীর দিয়েই কেঁদে ফেললেন,”দাদা ওদের কথা দিয়ে ফেলেছি। ব্যানার, পোস্টার পড়ে গেছে। আপনাকে যেতে হবেই।স্কুলের উন্নতিকল্পে প্রোগ্ৰাম।দেখো সব ছাপা হয়ে গেছে।” সে কান্না আর থামতেই চায় না। শেষ পর্যন্ত উত্তম কুমার বললেন,”এটাই আমার শেষ প্রোগ্ৰাম। তোর কথা আর কখনই রাখতে পারব না।” আবুর দিকে তাকিয়ে বললেন,”ঠিক আছে স্কুলের অনুষ্ঠান,আমি যাচ্ছি। জীবিত থাকলে এর অন্যথা হবে না।” তিনি শিল্পী সংসদের প্যাডে স্বাক্ষর করে দিলেন। টাকা হাতেও ছুঁলেন না। অজয়কে বললেন,”শিল্পী সংসদের তহবিলে ওটি দিয়ে দাও।” ‘সন্ন্যাসী রাজা’ তখন বাজারে হিট। আবু বলল,”আরেক সন্ন্যাসী রাজাকে তখন চোখের সামনে দেখলাম।” উত্তম কুমারকে এত কাছে পেয়ে গোবিন্দদা তো খুব খুশি।
এল সেই আগমনী দিন। ময়রা স্ট্রীটের বাড়িতে হাজির বাবুদা। তিনি গাড়িতে উঠলেন। তাঁর হাতে একটি খবরের কাগজ। সঙ্গে সিকিউরিটি অফিসার মোতাহার হোসেন।
হাতে কাগজ কেন? গাড়ির বাঁদিকে চেপে বসলেন উত্তমকুমার। এক হাতে কাগজটি ধরে মুখটি নিয়ে গেলেন কাগজের আড়ালে। সেই যে কাগজ তুললেন, নামালেন কাঁপা মোড়ে এসে। মধ্যমগ্ৰাম লেবেল ক্রসিংয়ে গাড়ি দাঁড়ালো। উত্তম কুমার! উত্তম কুমার! বলে রব উঠল। ধরা পড়ে গেলেন কৌতূহলী ফ্যানদের চোখে। ঘিরে ফেললেন তারা। একবার দেখতে চায় তাঁকে। মোতাহার বাবু কোনমতে সামাল দিলেন। তারপর নৈহাটি পার হবার সময় বাবুদাকে জিজ্ঞেস করলেন,”গাড়ি এখন কোথায়?” বাবুদা বলল,”নৈহাটি।” “ও, নৈহাটি! শ্যামল মিত্রের জায়গা। ওর বাড়ি তো একদিন এসেছিলাম” বলে আবার চলে গেলেন কাগজের আড়ালে।
কথা দিয়েছিলেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি এসেছিলেন। স্বজাত্যবোধে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে। স্পলডিং ময়দানে ছিলেন দশ মিনিট। বসেছিলেন সেই স্থিতধী ‘সন্ন্যাসী রাজা’র মতো। মানপত্র তুলে দিয়েছিলেন বিধায়ক শিক্ষক জগদীশ দাস। চতুর্দিকে রব উঠল,একটা গান,একটা গান শোনান। তিনি উঠে এলেন মাইক্রোফোনের সামনে। বললেন,”আমি যদি নিজে গান গাইতেই জানতাম,তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর মান্না দের কন্ঠে কি লিপ মেলাতাম!”
একটু শ্বাস নিলেন। চতুর্দিকে উজ্জ্বল চোখ দুটি খুঁজে বেড়ালো। মানুষ আর মানুষ, লোকারণ্য। তারপর স্তব্ধবাক জনতার কাছে তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বললেন,”এই অবিস্মরণীয় নৈশালোকে এই চন্দ্রাতপের নিচে আপনাদের ভালবাসার কাছে আমি নতশির। আমি কৃতজ্ঞ,আমি আপনাদের ভুলব না।” তিনি হাতজোড় করে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন এবং নিজেই দু হাজার টাকা তুলে দিলেন স্কুলের উন্নতিকল্পে।
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯শে মার্চ ১৯৭৬। মহানায়ক এসেছিলেন কাঁচরাপাড়ার মানুষের স্বার্থে, স্কুল গড়ার কাজে। এটি এখন ইতিহাস।