আনন্দ মুখোপাধ্যায় :: অবতক খবর :: ১লা,ডিসেম্বর :: কোলকাতা :: পরিসংখ্যান বলে, গোটা ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় পশ্চিমবঙ্গই এক নম্বরে। সাড়ে তিন দশকের বামপন্থী শাসনেও যেমন এই ছবিটা আগাগোড়া প্রায় একই রকম ছিল – গত পাঁচ বছরের তৃণমূল আমলেও তা বদলায়নি, বরং বেড়েছে। সোজা কথায় সারা দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষে পশ্চিম বঙ্গ শীর্ষে।
বিশেষত গ্রামবাংলায় প্রতিটি দলের মধ্যে নিয়মিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটেছে – অনেক ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে গাদা বন্দুক বা দেশি বোমা বানানোর কারখানা। প্রবল রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা থেকে তৈরি হয়েছে সংঘাত, বেড়েছে প্রাণহানি।
কিন্তু কেন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতা এত বেশি ? কেন ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় রাজনীতি এখানে বেশি রক্তাক্ত ?
পশ্চিমবঙ্গে নিয়মিত শিরোনাম হয় নানা রাজনৈতিক হানাহানির খবর – বিভিন্ন দলের মধ্যে, এমনই একই দলের নানা গোষ্ঠীর মধ্যে বোমাবাজি, খুনখারাপি এরাজ্যে প্রায় রোজকার ঘটনা।
ঘটনা হল, ৩৪ বছরের সিপিএম আমলে বিরোধীদের ওপর লাগাতার হামলা চালানোর একই অভিযোগ অবশ্য তাদেরকেও শুনতে হয়েছে। কিন্তু বাকি দেশ যেটা বুঝতে পারে না, তা হল শিক্ষিত,নম্র বা সংস্কৃতিবান বলে যে বাঙালির পরিচয় – তারা রাজনীতির বেলায় এত হিংস্র কেন ? বাঙালির ভাবমূর্তিটা আসলে একটু অন্যরকম বলেই এখানে হিংসার ছবিটা বেশি ভয়াবহ দেখায়!
বাঙালির এই যে নরম-সরম, কালচার্ড, সফিস্টিকেটেড ইমেজ সেটা বুর্জোয়া, উচ্চবিত্তদের তৈরি ইমেজ। গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ কিন্তু চিরকালই লড়াকু – রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ে বাংলার কৃষকদের সঙ্গে রায়লসীমা, কেরল বা ভারতের অন্য জায়গার কোনও পার্থক্য নেই!’ বামপন্থীদের গড়ে হিংসার ট্র্যাডিশন থাকলেও পাঁচ বছরের তৃণমূল আমলেও কেন তাতে রাশ টানা গেল না?
এর দায়ও আসলে কিছুটা বামপন্থীদেরই – যারা একটা বেকার যুবকদের প্রজন্ম তৈরি করে গেছে – যে যুবকরা হিংসা ও অপরাধে হাত পাকিয়েছে। ‘বাম আমলের প্রোডাক্ট এই বেকার যুবকরা কিছু করতে না-পেরে সিন্ডিকেট ব্যবসায় ঢুকেছে, দালালি শুরু করেছে। সেই কাঁচা পয়সায় তারা মদ-মেয়েমানুষ-অপরাধে ঢুকেছে। এই প্রজন্মটাকে শোধরাতে আমাদের দিদির (মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি) আরও দুটো টার্ম লেগে যাবে।
রাজ্যের বীরভূম, বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুরের নানা জায়গায় হিংসার ছবি ক্রমশই আরও বেশি রক্তাক্ত হয়েছে। তৃণমূল আমলে এই রাজ্য যেন ষাট বা সত্তর দশকের ভয়াবহ দিনগুলোতেই ফিরে গেছে। ভাবতে পারেন শুধু দেশি বোমা তৈরি করতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসেরই অন্তত ৫০জন এ রাজ্যে মারা গেছেন ? এই হিংসার কোনও মানেই হয় না।’
‘নানা কারণে, নানা অজুহাতে পশ্চিমবঙ্গ ষাট বা সত্তরের দশকে যেভাবে রক্তাক্ত হয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিও এ রাজ্যকে সেদিকেই আবার ঠেলে দিচ্ছে।’ আসলে সাম্প্রদায়িক উসকানি হয়তো পশ্চিমবঙ্গে কম – কিন্তু রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব খুবই বেশি,।
‘উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ের মতো কোনও ধর্মীয় নেতা হয়তো এখানে অমুকের মাথা কেটে ফেলার কথা বলবেন না – কিন্তু রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এখানেও পুরোদস্তুর আছে। রাজনীতি মানে যে ক্ষমতা রোজগারের জায়গা এটা সবাই বুঝে গেছে – ফলে একবার ক্ষমতায় এলে তারা সরতে চায় না, বিরুদ্ধ মতকে যে কোনওভাবে চাপা দিতে চায় এটাই রেওয়াজ হয়ে গেছে।’
নিজেদের দলের ভেতর খুনোখুনি – এ জিনিস পশ্চিমবঙ্গে আগে ভাবাই যেত না। কিন্তু এখন একটা দলের ভেতরই তিন-চারটে গ্রুপ। কোনও কাজের ঠিকাদারি নিয়ে হয়তো বচসা নেতারা ভাবছে আমাকে পেতেই হবে, পরে হয়তো সুযোগ পাব না। অন্যরা ভাবছে আমাদের এই ঠিকা নিতেই হবে, এভাবেই এগুলো বেড়ে চলেছে।’
ফলে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি মানে যে ‘গান্ধীগিরি নয়’ – বরং বোমাবন্দুকের ভাষা – গত পাঁচ বছরে সেই ধারণাই আরও জোরালো হয়েছে।