আজ ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে আসা জেলখাটা বামচেতনার কবি কমলেশ সেনের মৃত্যুদিনঃ অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন

কোনোদিন এইসব মানুষ
তমাল সাহা

আজ তমুর অত্যন্ত কাছের মানুষ প্রিয়জন, কবি কমলেশ সেনের মৃত্যুদিন।
তাঁর সঙ্গে কলকাতায় মিছিলে হাঁটা, একসাথে বসে আড্ডা। মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট, অনীক- এর দপ্তরে বৈকালিক বৈঠক। নকশালবাড়ি আন্দোলনের 30 বছরের অনুষ্ঠানে এসপ্ল্যানেড চত্বরের সেই ভিড়, শহীদ মিনার মাঠের সভা,ফেলে আসা দিনের আলোচনা, স্মৃতিবিজড়িত গল্প।
সে বলেছিল, ওপার বাংলার জীবন, মাঝি মাল্লার কথা আর পালিয়ে আসা কিন্তু জীবন কখনো ফতুর হয়নি তার।এপারে এসে মিশে গেল জনতার সমাবেশে। কবিতা, অনুবাদ সাহিত্য, তৃতীয় দুনিয়ার সাহিত্য– সেসব কথা হয়েছিল তার সঙ্গে। তার জীবন বিপ্লব চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন থাকলেও সংকীর্ণতা ছিল না তার। সুভাষ চক্রবর্তীর কথা সে বলেছিল, শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলেছিল। ধূসর হয়ে যাচ্ছে,এসব এখন মনে পড়ছে তমুর।

তাঁর জীবন বহুমুখী। ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে আসা জীবন তাঁর। ধীবরদের সঙ্গে কেটেছে তাঁর জীবন। পার্টির জীবন। জেলের গরাদের ভেতর তাঁর জীবন। অনুবাদক, বহুভাষায় জ্ঞানসমৃদ্ধ মানুষ। বহু কাব্যগ্রন্থ রয়েছে তাঁর। উল্লেখযোগ্য অনুবাদ মান্টোর গল্প।

সংগ্রাম এবং জীবন কিভাবে মিশে যায় সে কথা কতবার কতদিন শুনেছে তমু তাঁর কাছে। আর সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ গাছের মতো ছড়াতে থাকে, সে কোনো বাধা মানে না কোনো সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঘেরাটোপ। তার মধ্যে থাকে শুধু জীবন চেতনা, মানব চেতনা এটা সে শিখিয়েছিল কোনোদিন তমুকে। এমন শেখানো ও আলোচনার মানুষের সান্নিধ্য তমুর জীবনে এক দুর্লভ প্রাপ্তি।সে তমুর ‘গুণধর মুর্মু’ কবিতা পড়ে মুগ্ধতা দেখিয়েছিল। তমু তার নিজের লেখা দুটি কাব্যগ্রন্থ কোনোদিন তুলে দিয়েছিল তাঁর হাতে।

তাঁর জীবন সম্পৃক্ত কাব্যধারা তমু ধরে রেখেছে এক দীর্ঘ কবিতায়, যেটি মুদ্রিত হয়েছে ‘রুটির গান অথবা আকাশ’ কাব্যগ্রন্হে — ‘সে কবিতা হয়ে গেছে’ এই শিরোনামে। সেই কবিতা থেকেই এই অংশটি তুলে ধরছে তমু

পান্থজন
তমাল সাহা

হাঁটো হাঁটো আরও হাঁটো।
সে হাঁটতো কেননা
পথিক হতে চেয়েছিল সে।

পান্থজন পথ হারায় না।
নতুন নতুন পথ খুঁজে পায়
বলেই সে মিছিলে হেঁটেছিল,
শ্রমিক বস্তিতে গিয়েছিল,
গিয়েছিল চাষিদের পাড়ায়।

সে বলেছিল
জল আর জেল যে দেখেনি
সে কি মানুষ দেখতে জানে!
আর কি বলেছিল?
‘খোদাতাল্লার জন্য একটি পয়সা দাও।
খোদা কবে থেকে দু’বেলা শানকিতে ভাত বেড়ে খাননি।’

সে হেঁটে যেতে পারতো সহজেই
ঝড়, প্লাবন, আগুন, রক্তবৃষ্টির ভেতর দিয়ে,
পেরিয়ে গিয়েই ওপার থেকে চেঁচিয়ে উঠতো–‘বেঁচে আছি’….

তখন তার কাঁধের ঝুলি থেকে
বেরিয়ে আসতো অনর্গল কবিতা–
আমি বীজতলায় মানুষের জন্য
ধান রুইতে যাচ্ছি….
‘আপনি আমাকে সবুজ পিরহান দিন,
আল্লা,সবুজ পিরহান।’

মুনিজার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল সে
‘মুনিজা, তুমি আমাকে সেদিন
একবুক আকাশের জমিন দিও
আমি ফুল ফোটাব তারা ফোটাব।’

সুন্দরের অভিযানে যাবে বলে
তাকে দেখিয়ে বলেছিল,
‘মুনিজা! আমাদের পিঠের উপর শর ও ধনুকের কি আশ্চর্য শোভা।’

আর তারপরেই সেই বিশাল উচ্চারণ–
‘তোমার কাঁখের সন্তান
আমি ঘাড়ে নিয়ে পৃথিবী হাঁটছি।’