‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ এক নারীর
প্রয়াণ দিবসে
চন্দ্রাপীড়, জাগ এইবার
তমাল সাহা
কত কম জানি। ক্রমশ মাথা অবনত হয়ে আসে। ছোটবেলায় তোমার ক’টি মাত্র কবিতা পড়েছি। কবিতাপ্রেমী হয়েছি কিন্তু তোমাকে ভালো করে দেখিনি। পর্যবেক্ষণ করিনি তোমার কবিতার শারীরিক সারল্যের সৌন্দর্য।
বড় বড় কবিদের পাল্লায় পড়ে তোমাকে কি তেমন গুরুত্ব দিয়েছি? কবিদের সম্বন্ধে কখনো কিছু হয়তো লিখেছি কিন্তু নারী কবিদের নিয়ে তেমন কিছু লিখিনি। কেন লিখিনি এটাও কি অজান্তে কোন পুরুষতান্ত্রিকতা?
শব্দ সরলরেখায় চলে। জল উঁচু থেকে নিচুর দিকে বয়ে যায়। এই বৈশিষ্ট্যের লিখন শৈলী ছিল তোমার কবিতায়।
তোমার কবিতা স্বকীয়তায় সরল উচ্চারণে মানুষের কাছে সাহজিক মাত্রা পায়, সরল অমল মানুষদের কাছে পৌঁছে যায়। খুব চিত্রকল্প বৌদ্ধিক চিন্তন ছিল কি তোমার কবিতায়? অমিত্রাক্ষর–সনেটেও তোমার প্রতিভায় বিস্মিত আমি। তা কখনোই তেমন ভারবাহী মনে হয়নি। শিকড়ের কবিতা পেয়েছি তোমার লেখায়। অম্বা নাটকেও তোমার ধ্রুবপদ খুঁজে পেয়েছি।
পাছে লোকে কিছু বলে– কবেই তো প্রবাদ হয়ে গেছে। একটি স্নেহের কথা/ প্রশমিতে পারে ব্যথা/ চলে যায় উপেক্ষার ছলে /পাছে লোকে কিছু বলে।
তারপর বর্তমান সময়ে আমাদের মানসিক দুর্বলতাকে কবেই তো তুমি ধরতে পেরেছিলে আর বলেছিলে, ‘শক্তি মরে ভীতির কবলে।’
কত ভালবাসি? ভালবাসা কতদূর যায় আর ভালবাসার কি পরিমাপ করা যায় তা তো তুমি শিখিয়েছিলে আমাকে ছোটবেলায়। এমন সাহসিক শব্দ উচ্চারণে কেউ তো তখনও বলেনি কত ভালবাসি। ‘তুমি মা আমারে ভালোবাস কত খানি?’
মা বলে,মাপ তার আমি নাহি জানি।’ বুকে ধরে যতখানি— আহা! কী সহজ উচ্চারণ।
এরা যদি জানে— কি জানে? ‘উচ্চ কুলে জন্ম বলে কতদিন আর’ খুবই সরল মাত্রার উচ্চারণ অথচ ক্রান্তিকারী বিন্যাস।
তোমার কবিতার পংক্তিতে ছিল সামাজিক প্রহার।
চাহিবে না ফিরে– সামাজিক চেতনার মূল্যবোধের ছবি ভাষ্যচিত্র হয়ে ওঠে। ‘পথে দেখে ঘৃণা ভরে/ কেহ কেহ গেল সরে। কারা সরে কেন সরে যায়? এ প্রশ্নের অভিঘাত তুমি তুলে ধরো কবিতায় অথবা স্মৃতিচিহ্ন-এ কি লিখেছিলে তুমি? ‘দরিদ্র আছিল তারা, ছিলনা সম্বল/ তাদের রাজত্ব হেরো অক্ষুন্ন কেমন/ ……কাল স্রোতে ধৌত নাম নিত্যসমুজ্জ্বল।
আমাদের জন্য রেখে গিয়েছো আলো ও ছায়া, মাল্য ও নির্মাল্য, দীপ ও ধূপ কাব্যগ্রন্থসমূহ।
শেষবেলা ডেকে বলে গেছো, চন্দ্রাপীড়, জাগো এইবার।
এসেছিলে ১২ অক্টোবর ১৮৬৪। চলে গিয়েছো ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩।
বাংলার কাব্য কাননে ফুটেছিল কামিনী। নিজের ছদ্মনাম রেখেছিলে ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’।
তোমার কথা বিস্মৃত হয়েছি, মনে রাখিনি। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে তুমিই ছিলে প্রথম মহিলা স্নাতক রমণীয় রমণী। কবি কামিনী রায়! তোমাকে প্রণমি।