আজ ঈদ, মুবারক জানাই
নাজমা ও রিজিয়াদের বাড়ি
তমাল সাহা
এইভাবে জীবনানন্দের বাঁকা চাঁদ,দীনেশ দাসের কাস্তের মতো চাঁদ, বীরেন চাটুজ্জের এই ছোকড়া চাঁদ, জোয়ান চাঁদ পশ্চিম আকাশে এক ফালি চাঁদ হয়ে গেলে ঈদ চলে আসে সমগ্ৰ বিশ্বপাড়ায়।
নাজমার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে রিজিয়ার কথা। আনোয়ার, হোসেনের কথা। মুসলিম আলির সেই দিলখোলা আওয়াজ এখনো ভেসে আসে কানে। এইসব ক্লাস ফোরের জীবন।
টিফিনে হজমি গুলি খাওয়ার জীবন। টিফিনে ঘুগনি খাওয়া জীবন, টিফিনে মাছ, সিগ্রেট লজেন্স আর টিকটিকির ডিম লজেন্স চুষে চুষে খাওয়ার জীবন।
নাজমা আর রিজিয়ার বাড়ি পাশাপাশি। পাল্লাদহ গাঁয়ে। অফিসার্স কলোনির লাভার্স ব্লিজ পেরিয়ে দীর্ঘ পিচ ঢালা রাস্তা। দুদিকে কত সব গাছ। আম,জাম,জারুল, পেয়ারা তো আছেই। আছে শাল সেগুন কৃষ্ণচূড়া। এইসব বৃক্ষগুলি সটান দাড়িয়ে থাকে আর তমুকে দেখে। সেসব ব্রিটিশ পিরিয়ডের বাংলো। সোজা বাংলায় সাহেবি বাংলো। বিকেল হলে তমুরা চলে যেতো অফিসার্স কলোনি। লাভার্স ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকতো।হাওয়া খেতো। তার নিচ দিয়ে বয়ে যায় দীর্ঘ বিশাল খাল।
অফিসার্স কলোনির ভেতরে অফিসার্স ক্লাব। সে অদ্ভুত এক ক্লাব। বিশাল লন তার, সাহেবরা লন টেনিস খেলছে। পায়ে সাদা কেডস, পরনে সাদা হাফপ্যান্ট,সাদা গেঞ্জি, হাতে সেইর্্যাকেট কি তার আওয়াজ! বল নেট পেরিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে। অফিসার্স ক্লাবের সামনে বিশাল বারান্দা। ভেতরে পানশালা। তখন তমু বুঝত না যে সাহেবরা এভাবে ক্লাবঘরগুলোতেও মদ খায়। বলড্যান্সে রুম ছিল সেখানে।
মেঝেতে কাঠের পাটাতন। বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা।
এইসব ক্লাস ফোরের গল্প। তমু চলে যেত, বিশেষ করে একটি বিশেষ দিনে সেই ঈদের দিনে নাজমা রিজিয়াদের বাড়ি। সেই পাল্লাদহে। এখন যেখানে কল্যাণী ব্যারাকপুর এক্সপ্রেসওয়ে তখন তো সেটা ছিল না। সেখানে জমি বাড়ি সব ছিল। এইসব সরকারি আওতায় এনে এখন বিশাল সড়ক। এই মাঠের উপর দিয়ে চলে যেতে হতো নাজমা-রিজিয়াদের বাড়ি। নাজমাদের বাড়ি ঢুকতেই বাঁদিকে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ায়। অদ্ভুত রহস্যময় করে তোলে বাড়িকে। এটা তমু প্রথম দেখল। তারপর বিশাল রোয়াক। তকতকে ঝকঝকে।রোদের কিরণ পড়ে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। বাঁশের খুঁটির ঘর, ঘরের বারান্দায় মাটির উনুন, মাটির হাঁড়ি, কাঠের জ্বালানি আহা! সিমুই পায়েস ফুটছে। গন্ধ ছড়িয়েছে চারদিকে।
নাজমার বাবা আনিসুর চাচা বললেন, বোসো। সারাদিন থাকবে আমার বাড়িতে। রিজিয়া বলত, এই তমু! আমাদের বাড়ি যাবি না? তমু বলতো,যাবো তো।
রিজিয়ার বাবা মনসুর চাচা। তিনিও চাষাভুষো মানুষ। ওপার বাংলা থেকে এসেছেন ঢাকার মীরপুর থেকে। এখনও বাঙাল কথার টান ছাড়তে পারেননি। রিজিয়াদের বাড়ি ঠিক একই রকম মাটির। ওদের উঠোনে তমু দেখলো বিশাল লম্বা মত একটা ঘর। বিচুলি দিয়ে তৈরি মাথায় বিচুলির ছাউনি। অদ্ভুত তার আকৃতি। তমু দেখেই তাকিয়ে রইলো। রিজিয়া বলল, হা করে কি দেখছিস? ওটা মড়াই ঘর। ওতে থাকে জীবনের মহৎ সঞ্চয়। জীবনের ধান। জমা করে রাখা হয় সম্বৎসরের জন্য।
—- এই রিজিয়া কার সঙ্গে কথা বলছিস রে? তরতরিয়ে চলে এলেন রিজিয়ার বাবা মনসুর চাচা।
—- বাবা! তমু এসেছে আমাদের বাড়িতে। ঈদের উৎসবে ওকে নেমতন্ন করেছিলাম। নাজমারাও করেছে। ওখানেও খাবে।
মনসুর চাচা বললেন, ওদের ওখানে যদি খাও আমাদের এখানে রাতে দাওয়াত রইল তোমার।
দাওয়াত শব্দটি এই প্রথম শুনতে পেল তমু। মানে আহারের আমন্ত্রণ।
তমু ঝামেলায় পড়ে গেল। বুঝতে পারেনা কোন বাড়িতে কখন খাবে। তমু বলে,কেন? আমরা যদি আজ একসঙ্গে খাই, নাজমাদের ওই বিশাল উঠোনে। এই রাজিয়া,তোদেরও খাবার থাকবে, নাজমাদেরও খাবার থাকবে। আমরা সব গোল করে ঘিরে বসে ওখানে খাব। নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাত্রির আহার সব। মাথার উপরে ঈদের চাঁদ জ্বলবে, ভালো হবে না?
নাজমার বাবা আনিসুর চাচা বললেন, ভালো আইডিয়া দিয়েছিস তো তুই। হতে পারে এটা। তাই হবে।
আনিসুর চাচা বললেন, ঈদ হলো আসলে উৎসব। এর অন্য মানে ফিরে ফিরে আসা। প্রত্যাবর্তন। ফিতর মানে হলো আনন্দ, উপহার। আর নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ার দিন। মনসুর চাচা বললেন,অতশত আমি জ্ঞানের কথা বুঝি না। ঈদ হইল ওই আকাশের এক ফালি ফুটফুটে চাঁদ। উপোস মানে রোজা,নামাজ মানে প্রার্থনা আর ফিতর মানে উপহারের দিন হল ঈদ। মানুষরে লইয়া আনন্দ করো, ফূর্তি কর, এর নামই হইল ঈদ।
আনিসুর চাচা বলে ওঠেন, তোমার নাম কি? নাজমা বলে ওঠে,আব্বা ও আমাদের সঙ্গে পড়ে। ওর নাম তমাল। তমু বলে আমরা ডাকি।আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। খুব ভালো ছেলে। ওর হাতের গোটা গোটা লেখা দেখোনি তো, কাঠ পেন্সিল দিয়ে কি সুন্দর লেখে। মনসুর চাচা বলেন, তুমি তো তাহলে বড় ভালো ছেলে। তমু বলে, চাচাজি!নাজমা আর রিজিয়াকে আমাদের পাঠশালার হেডমাস্টারমশাই খুব ভালোবাসেন। ওরা ক্লাস শেষে হেড মাস্টারমশাইয়ের একটা একটা করে পাকা চুল তুলে দিত। অদ্ভুত এসব দৃশ্য। এই দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না।
মনসুর চাচা বলেন, শোনো তোমাগো দুগ্গা পূজা হয় তো, বিজয়া-দশমী হয় তো,ওই যে দুর্গা ভাসান এর পর কোলাকুলি মিষ্টি খাওয়া খাওয়ি,পড়শি গো বাড়ি মিষ্টি লইয়া যাও,বিলাও, প্রণাম করো, আমাগো হ্যাঁ হেইডাই হইলো ঈদ। আমি মুখ্যসুখ্য মানুষ আনিসুরের মতো অত পাশ দেই নাই। জ্ঞানগম্যিকম, অত গুছাইয়া কথা কইতে পারিনা। আনিসুরের জোতজমি আছে ও রেলে কাম করে। আমি শুধু চাষবাস করি। আনিসুর চাচা বলেন, এর জন্য আমাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই।
তমু রিজিয়াকে বলে, রোজা তো শেষ আজকি কি খাবার বানাবি?
রিজিয়া বলে, বানানো তো শুরু হয়ে গিয়েছে! সিমুইয়ের পায়েস, ফিরনি, পোলাও বা বিরিয়ানি, মুরগি-খাসির মাংস সালাদ,বোরহানি। তুই আসবি বলে মাকে বলেছি, মা, তমুকের নেমন্তন্ন করেছি গোস্তের আয়োজন করোনা।
তমু বলে, আমি কোনোদিনও খাই নি। আজ খেয়ে দেখতাম।
নাজমা বলে উঠলো, এরপর যেদিন গোস্ত হবে তোকে বলবো।
তমুর মনে পড়লো, মোসলেম আলির সুন্নতের অনুষ্ঠানেও তো সে গিয়েছিল। মুরগিপাড়ায় ছিল মোসলেমদের বাড়ি। তমু মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, মা আমাদের এই অনুষ্ঠান হয় না কেন? মায়ের উত্তর ছিল, ওটা মুসলিমদের অনুষ্ঠান বাবা!
তার আরো মনে পড়লো শোভা বারিকের কথা। শোভাও তমুকে খুব ভালোবাসতো। শোভা বিয়ে করেছিল বীজপুর থানার এক দাপুটে পুলিশ ইন্সপেক্টর মোকসেদ আলি। সত্তর দশকে সে কাঁচরাপাড়ার যুবকদের নাস্তানাবুদ করেছে।
গভীর রাতে এসে তমুদের বাড়ি পাড়া তল্লাশি করেছে। তমু তখন জানতো না,শোভার হাসব্যান্ড মোকসেদ। সে অনেক পরের কথা। মোকসেদ বাবু বলেন, তখন কি আমি জানতাম রে আমার থেকেও অনেক আগে আপনার সঙ্গে শোভার বন্ধুত্ব। তাহলে তো আপনার বাড়ি বাদ দিয়ে খানা তল্লাশি করতাম।
যাক ঈদের কথায় ফিরে এলো তমু্।
রিজিয়া বলে, একটাই আকাশ।ওঠে পূর্ণিমার গোল চাঁদ, হয় লক্ষ্মীপুজো। উঠোনজুড়ে কত আলপনা, লক্ষ্মীর পা,সারি সারি খালা ভর্তি নাড়ু!একটাই আকাশ, এক ফালি চাঁদ,এত খাবারদাবার এটা আমাদের ঈদ।
তমু বলে, আসল জীবন তো আমাদের জোড়াতালি।
চাঁদের জোৎস্নায় একটা দিন এতো আনন্দ সুখ, আলিঙ্গন- কোলাকুলি।
তমু বলে,
কান পেতে শোন্ কি বলে ঈদ!
আমরা বড় কিছু নই,
আমরা পরস্পর সুহৃদ।