‘নকশাল!’ অমর্ত্য গ্রেফতারি থেকে বেঁচেছিলেন
তমাল সাহা
১৪ অক্টোবর ১৯৯৮ জনকল্যাণ বিষয়ক অর্থনীতির কাজে নোবেল পুরস্কার অর্জন করলেন অমর্ত্য সেন। ১৯১৩ সালে প্রথম ভারতীয় বাঙালি রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৯৮ সালে ৮৫ বছর পর দ্বিতীয় বাঙালি এবং ষষ্ঠ ভারতীয় অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার লাভ করলেনৃ রয়াল সুইডিস একাডেমী পরিচালিত এই নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য ৯.৩৮ লক্ষ ডলার অর্থাৎ প্রায় চার কোটি টাকা।
রসিক অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কোনোদিন বলেছিলেন, এস ফর সামবডি, ই ফর এভরিবডি এন্ড এন ফর নো বডি।
অমর্ত্য সেন পুরস্কার পেয়েছেন এবং ভারতীয় বাঙালি, এ বিষয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। কিন্তু আমরা কেন কলকাতা বা ভারতবর্ষে তার অধ্যাপনার ও গবেষণার পরিবেশ গড়ে তুলে দিতে পারেনি,কেন তিনি বিদেশে পাড়ি দিলেন সে কথা আমরা বিন্দুমাত্র উচ্চারণ করছি না। তিনি যদি ভারতে থাকতেন তবে তার শিক্ষকতার আলোকে নব প্রজন্ম আরো ঋদ্ধ হতে পারতো। তার পাণ্ডিত্যের কথা তো সর্বজনগ্রাহ্য এবং পূর্বেই জ্ঞাত ছিল। তবে তাকে কেন দেশে রাখা গেল না! প্রখ্যাত সংবাদপত্র ও পন্ডিতপ্রবরদের মুখ থেকে শুনছি ৭০ দশকেই তার নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। জনকল্যাণ অর্থনীতিতে সুদীর্ঘ বছর ধরে যার প্রজ্ঞা সন্দেহাতীত, রাজ্য তথা দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রচনায় তাকে কোনদিন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কি? কতবার তার পরামর্শ নেওয়া হয়েছে? তাকে নাগরিক সংবর্ধনা তার নামে চেয়ার প্রতিষ্ঠা নিয়ে আমাদের এখন তুমুল হইচই। বিদেশি স্বীকৃতির জন্যই কি আজ আমাদের দাঁড়িপাল্লায় তার মূল্য সূচিত হচ্ছে?
কলকাতার আইবি ডেপুটি কমিশনার রঞ্জিত গুপ্তর লেখা থেকে আমি যতটুকু জেনেছিলাম, নকশাল অমর্ত্য গ্রেফতারি থেকে বেঁচে ছিলেন!অমর্ত্য সেনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ এটা শুনে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। এটা তার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি সংবাদের মতোই সত্যি।
ডেপুটি কমিশনার রঞ্জিত গুপ্ত লিখেছেন, নকশালাইট পিরিয়ডে সেই তুফান তোলা সময়ে আমি সেই মানুষ যে দিল্লী পুলিশের কাছ থেকে তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ পেয়েছিল। ১৯৬৯-এ দিল্লী পুলিশের কমিশনারের কাছ থেকে অমর্ত্য সেনকে গ্রেপ্তারের জন্য আমি একটি চিঠি পাই। সেই চিঠিতে অমর্ত্য সেনকে নকশাল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। আমি তখন কলকাতার ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ-এর ডেপুটি কমিশনার। চিঠিতে অভিযোগ ছিল, দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক হিসেবে অমর্ত্য সেন ছাত্রদের নকশাল হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে চলেছেন। তখনই অমর্তর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সে ছিল আমার স্ত্রীর নিকট সম্পর্ক জড়িত প্রথম ভাই। ওকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ পালনে আমার তেমন উদ্বেগ ছিল না। সৌভাগ্যবশত অমর্ত্য তখন কলকাতায়। আমি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করলাম এবং ওর সঙ্গে আলোচনার দিন ঠিক করলাম। সেন পরিবার আমাকে একটা চা-পর্বে ডাকলেন। অমর্ত্যর সঙ্গে আমার কথা হল। আমি অমর্ত্যকে বললাম, তোমাকে গ্রেপ্তারের জন্য দিল্লি থেকে আমার কাছে নির্দেশ এসেছে।
এমনিতে ওকে একটু আশঙ্কিত দেখালো।
এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সন্ধ্যেবেলা অমর্ত্যর বাড়ি আসতো। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হতো। অমর্ত্য বললো, সমসাময়িক বৈপ্লবিক রাজনীতি নিয়ে ডিএসই-র কিছু ছাত্র তার সঙ্গে আলোচনা করতো, এটা তো ঠিকই। যে কোনভাবেই হোক আমার মনে হলো অমর্ত্য নকশাল হতে পারে না। আমি ওকে বললাম যে তার ভয়ের কিছুই নেই। সে স্বচ্ছন্দে দিল্লি যেতে পারে। কিন্তু অমর্ত্য দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। আমি বললাম তাদের সঙ্গে মিশে বা আলোচনা করতে কোন বাধা নেই… সেই দিনগুলোতে বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশেরা নকশালদের সন্ধানে তল্লাশি চালাচ্ছিল।
অমর্ত্যকে গ্রেপ্তারের কোনো ভিত্তি নেই জানিয়ে আমি দিল্লী পুলিশকে নির্দেশ ফেরত পাঠিয়ে দিলাম এবং এ কথা তখনকার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ডিরেক্টর মিস্টার এম এম এল হুজাকে জানালাম। এর কিছুদিন পর আমি অমর্ত্যর কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম। সে লিখেছে, লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স একটি বিশেষ চেয়ার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেই পদ গ্রহণের জন্য তাকে অনুরোধ করেছে। আমি তাকে তার করে জানালাম পরবর্তী বিমান ধরেই তুমি লন্ডন চলে যাও। সে চলে গেল এবং নতুন জীবন শুরু করল। ৭৮-এ আমার স্মৃতি বেশ ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। নোবেল লরিয়েটের মা যদি আমাকে চিঠি না লিখতেন তবে এই কাহিনী গোপন গভীরে চলে যেত। নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হবার পর পুত্রের সাফল্যের সংবাদে আমি অমিতা সেনকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। তিনি তার জীবনের এই আনন্দঘন মুহূর্তের জন্য আমাকে ধন্যবাদসহ এও জানালেন, তুমি যদি সে সময় অমর্ত্যকে জেলখানায় পুরে দিতে, তবে বোধ হয় আজকের :এই ঘটনা’ সম্ভবই হতো না।
তিনি আরো লিখেছেন, তুমি আমাদের নিউ আলিপুরের বাড়িতে এসেছিলে। বলেছিলে, কারো এমন বুকের পাটা নেই যে অমর্ত্যকে গ্রেফতার করে। যদি তাই হয় তবে সমগ্র দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে।
উল্লেখ্য এই লেখাটি ১৯৯৮ সালে বিজপুর মুখোমুখির ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ভাষান্তরঃ(আংশিক) তমাল সাহা। কৃতজ্ঞতাঃ দ্য স্টেটসম্যান
আরো উল্লেখ্য রঞ্জিত গুপ্ত একসময়ের ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কমিউনিস্ট নেতা ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর ভ্রাতা। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ১৯৫৪ সালে বিজপুরের উপনির্বাচনে হিন্দী ভাষায় ভাষণ দিয়ে গিয়েছিলেন শ্রমিক মহল্লা হালিশহর স্টোর ব্লকে হিন্দীভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলে। সে লড়াই ছিল কংগ্রেস নেত্রী মৈত্রেয়ী বোস ও কমিউনিস্ট বিপ্লবী নিরঞ্জন সেনের লড়াই। এই লড়াইয়ে প্রথম কমিউনিস্টরা বীজপুর বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়।
১৯৬৯ সালে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত এসেছিলেন ইস্টার্ন রেলওয়ে ওয়ার্কশপ কনফারেন্সে। সেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্পল্ডিং ইনস্টিটিউটে। তখন তিনি ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। তিনি ছিলেন একজন ডাকসাইটে সুবক্তা সাংসদ।
তিনি ১১ বার সাংসদ নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড করেছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।