বিদ্যাসাগর এবং হালিশহর
ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর’ শিরোপা অর্জনের জন্য হালিশহরের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন
তমাল সাহা
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। গঙ্গাধর তর্কবাগীশ যদি না থাকতেন তবে কি ঈশ্বরচন্দ্র, ‘বিদ্যাসাগর’ হতে পারতেন? আর আজ তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা এত সব প্রসঙ্গ উঠতো? বর্ণপরিচয়, নারীশিক্ষা বিস্তার, নারীদের সমাজে স্থান করে দেওয়া, বাল্যবিবাহ রোধ,বিধবা বিবাহ প্রচলন– এক এলাহি কাণ্ড! তার ওপর তো লোকের গালিগালাজ, তিরস্কার, শারীরিক নিগ্ৰহ ঢিল পাটকেল খাওয়া ছিলই তাঁর কপালে।
যাই হোক অন্য এক গল্পের কথা বলা যাক। গঙ্গাধর তর্কবাগীশ। কে এই গঙ্গাধর তর্কবাগীশ? হালিশহরে রয়েছে ঘোষাল গলি লেন। ‘হালিশহরের মানুষ’ গ্রন্থে হীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, রাস্তার দক্ষিণ পাশে পরপর তিনখানি বাড়ি। বাড়িগুলি আছে কিন্তু ঘোষাল পরিবার নাই।
আরো কতগুলি ঘোষাল বাড়ি ছিল সেগুলি আজ অবলুপ্ত। এই ঘোষাল বংশে শিবপ্রসাদ তর্কপঞ্চাননের পুত্র গঙ্গাধর তর্কবাগীশ। তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, ছিলেন ব্যাকরণবিদ। অনুমিত হয় এই অঞ্চল ঘোষাল পদবী বিশিষ্ট রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বসবাস করতেন। গঙ্গাধর তর্কবাগীশ কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ শাখার অধ্যাপক ছিলেন। সেটা ১৮২৫ সাল। তাঁর হাতে গড়া ছাত্র ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখ।
এই দুই মনীষী বাংলাভাষার জন্য, বাংলা বর্ণের সঙ্গে পরিচিতির জন্য যে কাজ করে গিয়েছেন তার জন্য বাঙালি হিসেবে আমরা তাঁদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব তো নিশ্চয়ই। ভাবা যায় এই হালিশহরের মানুষ অর্থাৎ অর্থাৎ গঙ্গাধর তর্কবাগীশ নিজে হাতে গড়ে পিটে তুলেছিলেন অনন্য এইসব প্রজ্ঞাবানদের। জানা যায় গঙ্গাধর তর্কবাগীশ সেই সময় কলকাতায় থাকতেন। কলকাতার সিমলা অঞ্চলে একটি বাড়ি কিনে বসবাস করতেন। শিবচন্দ্র দাসের গলিতে বাড়িটি ছিল। ১৮৪৪ সালে গঙ্গাধর তর্কবাগীশ প্রয়াত হন।
বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘১৮২৯ খ্রিস্টীয় শাখে জুন মাসের প্রথম দিবসে, আমি কলিকাতাস্থ রাজকীয় সংস্কৃত বিদ্যালয়ে বিদ্যার্থিরূপে পরিগৃহীত হই। তৎকালে আমার বয়স নয় বৎসর। ইহার পূর্বে আমার সংস্কৃত শিক্ষার আরম্ভ হয় নাই। ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়া, ঐ শ্রেণীতে তিন বৎসর ছয় মাস অধ্যয়ন করি।প্রথম তিন বৎসরে মুগ্ধবোধ পাঠ সমাপ্ত করিয়া, শেষ ছয় মাসে অমর কোষের মনুষ্যবর্গ ও ভট্টিকাব্যের পঞ্চম স্বর্গ পর্যন্ত পাঠ করিয়াছিলাম। কুমারহট্ট নিবাসী পূজ্যপাদ গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মহাশয় তৃতীয় শ্রেণীর অধ্যাপক ছিলেন। শিক্ষাদান বিষয়ে তর্কবাগীশ মহাশয়ের অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল।’
বিশেষ করে ঈশ্বরচন্দ্রকে, আর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে কিভাবে শ্লোক শেখাতেন সে কথা তিনি বিশদভাবে বলে গিয়েছেন তাঁর লেখায়।
ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর’ সম্মান স্মারক রূপে যে মানপত্র অর্জন করেছিলেন তার নিচে গঙ্গাধর তর্কবাগীশের স্বাক্ষর ছিল। তাঁর হাতে গড়া মহান ছাত্রই শেষ পর্যন্ত ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি শিরোপা অর্জন করেছিলেন।
সংস্কৃত ভাষা,ব্যাকরণ ও সাহিত্যে সাগরতুল্য অমিত পাণ্ডিত্যের জন্যই সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি এই উপাধি লাভ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তখন থেকেই ‘বিদ্যাসাগর’ রূপে পরিচিতি পেয়ে যান। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বহু ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামে দস্তখত করেছেন। জানা যায় তাঁর অফিসিয়াল সিগনেচার ছিল–ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। ‘শর্মা’ উপপদ নামক উপাধি। আরো জানা যায়, এটি ব্রাহ্মণ বর্ণের পরিচিতি প্রকাশ করে। প্রশ্ন উঠতে পারে ঈশ্বরচন্দ্র কি বর্ণভেদে বিশ্বাস করতেন? তাঁর রচিত বহু গ্রন্থেই তিনি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা এই পরিচিতিতে স্বাক্ষর করেছেন।
দয়ার সাগর নামেও তিনি পরিচিত। তাঁর কার্মাটরের জীবন অথবা ঠনঠনিয়া অঞ্চলে সেই মুড়ি মুড়কি বিক্রেতা নারীর হাতে ফলার করার ঘটনা তো জাতপাত বর্ণ বৈষম্যের কথা বলে না বরং অন্য কথাই বলে।
এইসব ক্ষেত্রজ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এই জনপদের সঙ্গে জড়িত। এইসব পুরাতনী কথা জানলে কার হৃদয় না উষ্ণ হয়ে ওঠে!