ভারতে মে দিবসের একশো বছর আমি ও কলকাতা
তমাল সাহা
নিশি বুঝি ডাকে আমায়! নিম পেঁচা নিম নিম রবে গান গেয়ে যায়। সে কী তবে আমাকে নিয়ে যাবে অদৃশ্য অজানা ঠিকানায়? এতসব নিশিলিপি আমি লিখে রেখে যাব কার কাছে?
আজ মে দিবস। বরাবরই মে দিবস আমাকে টানে। এবার ভারতে মে দিবস একশো বছরে নীরবে মাথা নিচূ করে হেঁটে যায়। কৃষ্ণচূড়া শিমুল পলাশ মান্দারের উজ্জ্বল প্রহর এবং প্রহার আমার চেতনায় অভিঘাত হানে। লালিমা কে না ভালোবাসে? আমি আজ চলে যাই কলকাতা। সেখানে চলে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। হঠাৎ কি মনে হল যেন! কলকাতার দিকে কেন!
জীবন বুঝি ছোট হয়ে আসে! নাকি দেখার বিস্তৃতি বাড়াতে আগ্রহ বাড়ায়? তাতে কি পর্যবেক্ষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়? একা একা ঘুরি আমি প্রজন্মদের ভিড়ে রবীন্দ্রসদন চত্বরে। দূরে ঐ একাডেমি হল দেখা যায়। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। কেন যেন মনে হয় এই সময় নবপ্রজন্মের সঙ্গে কিছু কথা বলি। দুএকটি শান্ত সমাহিত মুখ দেখে সদ্য তরুণী বোধ হয়। মনে হয় তাদের সঙ্গে কথা বলি। প্রৌঢ়ত্বের ভার অনেকটাই কেটে যায়। তারা সিনেমা দেখবে বলে লাইনে দাঁড়িয়েছে। নন্দনে কি কি চলচ্চিত্র হবে আর জিজ্ঞেস করে বুঝি কদিন ধরে তারা ঘুরছে এই চত্বরে। বলে দেয় কোথায় কোথায় সিনেমা দেখানো হবে, কোন কোন হলে চলছে চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রদর্শনী। তারা বলে, আপনি লতা সন্ধ্যা তারপর স্বাতীলেখাকে কেন্দ্র করে প্রদর্শনীও দেখতে পাবেন। চলে যান ওই কক্ষে।
তারা দেখে চলচ্চিত্র উৎসব। আমি দেখি চলমান চিত্র। আমার মগজে সান্ধ্য আইন কবেই হয়ে গেছে জারি। সব সময় দেখি আমার চেতনা মাড়িয়ে দুরন্ত ছুটে যায় সাঁজোয়া গাড়ি!
সে যাই হোক। রৌদ্রক্লিষ্ট রবীন্দ্রসদন চত্বর জুড়ে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রদর্শনীগুলির দৃশ্যসজ্জা আমি ঘুরে ঘুরে দেখি।
তারপর? সন্ধ্যা হলে চলে আসি একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের অডিটোরিয়ামে। ব্যারিকেড নাটকের নতুন প্রযোজনা করেছে চাকদহ নাট্যজন। আজ বোধ করি তৃতীয় প্রর্দশন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিস্ট বিধ্বস্ত জার্মান ও আমাদের রাষ্ট্রের চলমান শাসনব্যবস্থার সাযুজ্যের নাটক দেখি আর নিজেকে জারিত করি। একাডেমির আলো-আঁধারিতে কাছে পেয়ে যাই আমার প্রিয় নাট্যজনদের। নির্দেশক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয়। কথা হয় নাট্যজন-এর অন্যতম পরিচালক অভিনেতা সুমন পালের সঙ্গে । কথা হয় নাট্যকর্মী ও এই নাটকের অভিনেতা দীপক নায়েক, আমাদের কাঁচরাপাড়ার বাবুনি- মনোজ প্রসাদ যে এই নাটকে আলোর নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আমাকে হতবাক করেছে। আলাচনা হয় নাট্যনির্দেশক দেবেশ চট্টোপাধ্যায় ও নাটকের অন্যতম দুই চরিত্র সুমন পাল ও সঞ্জীব সরকারের সঙ্গে।
এই বিশেষ দিনে দেখি সিপিএমের নেতৃত্ব বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম এসেছেন। তারাও নাটক দেখতে এসেছেন। তাদের সঙ্গেও একপ্রস্থ সৌজন্যমূলক কথা হলো। দেখি অভিনেত্রী উষসী চক্রবর্তীকে, অভিনেতা রজতাভ দত্তকে। আর আমাকে সান্নিধ্য দেয় নাট্যজগতের সুপরিচিত অচিন্ত্য দত্ত, নাট্যকর্মী বাবলু দাশগুপ্ত এবং নাট্যপ্রেমী কল্যাণীর একটি মেয়ে সঞ্চারী ভট্টাচার্য।
হল থেকে বেরিয়ে গ্রিন রুমে ঢুকে নাটকের কুশীলবদের সঙ্গে আলোচনায় মাতি। পড়ন্ত বেলায় যেন পুরনো জীবনকে ফিরে পাই। স্মৃতির পুনর্জীবন ঘটে। এদের মধ্যে দেখতে পাই যেন সেই আমার প্রিয় উৎপল দত্তকে, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা সেনকে। চন্দ্রিল আকাশের নিচে নিজেদের মধ্যে চলে এক উত্তেজিত আলোচনা–সেই প্রকৃত কমরেড যে গড়ে তুলতে পারে ব্যারিকেড!
সে সে যাই হোক, নাটক নিয়ে পরের পর্বে লেখা যাবে। এখন লিখি চলচ্চিত্র উৎসব দেখে আমার অনুভব।
চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছে। জীবনের চলমান ঘটনাবলীর দিক থেকে মুখ সরিয়ে চল দেখে আসি ফিল্ম।তারপর মেরে থাকি ঝিম।
চলচ্চিত্র উৎসব
চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হতেই
উদ্বেলিত হয়ে ওঠে সিনেপ্রেমীজন।
শিল্পকলায় উদ্ভাসিত সব ছবি।
শব্দ আলো ক্যামেরার যুগপৎ
এক আশ্চর্য সম্মিলন।
ছবি দেখায় জীবনেরই, সে তো ঠিক।
লড়াই সংগ্ৰাম ভালোবাসা—
সবকিছুই থাকে
কোনোটিই নয় বেঠিক।
পর্দা একের পর এক
কত বিচিত্র দৃশ্যপট আঁকে,
অডিটোরিয়ামে বসে বসে দেখি
আর দেখি
এসি মেশিনটি বসানো দেয়ালের ফাঁকে।
ছবি দেখে কত কি শিখি
মনতাজ জুম ক্লোজ বিভিন্ন শট।
কি দারুণ! কি দারুণ!
একেই বলে ক্লাসিক শিল্পকলা।
হলের ভেতরেই উত্তেজনার সে কী রেশ!
বাইরে বেরোলেই এক নিমেষে সব শেষ।
প্রেক্ষাগৃহের বাইরে রাখি পা—
দেখি কাতারে কাতারে পুলিশ
মিছিলের মুখোমুখি
যানজট,রাস্তাঘাট পুরোপুরি বন্ধ—
চলমান চিত্র দেখি, চলচ্চিত্র অন্ধ।
মুহূর্তে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস,গুলি
ক্যামেরা সোজাসুজি,উদ্যত বুমগুলি।
আরো দূরে যাই
শহর ছাড়িয়ে দূরে গ্রামের কিনারে
ধর্ষিতা মেয়েটি পড়ে আছে এঁদো বাঁশবনে।
তখন বলি-টলিরা প্রদীপ জ্বালিয়ে
মন্ত্রীর সঙ্গে হাস্যমুখর উৎসব অঙ্গনে।
আরো দূরে যাই,
দেখি ধর্মের মিছিল অস্ত্রশস্ত্র হাতে।
আরও একটু এগোতেই দেখি
কারা হেঁটে যায় ফেট্টি মাথাতে।
যতো দূরে যাই ততো দেখি
বাস্তব ক্লাসিক দৃশ্যের পর দৃশ্য,
জীবন আমাদের শরশয্যায়
শায়িত ভীষ্ম।
বন্ধ কারখানা, ধোঁয়াহীন চিমনি
ভঙ্গিল প্রাচীর, শুনশান স্তব্ধতা—
এটাই চলমান শ্রমজীবীর জীবনী।
তুমি দেখো চলচ্চিত্র
সে তো ঘরবন্দি নির্দিষ্ট সময়ে
ছবিতোলা ক্যামেরায়।
প্রেক্ষাগৃহের বাইরে
এইসব চলমান চিত্র ঘটে যায়।
চলচ্চিত্রের আধুনিক প্রযুক্তি নির্মাণ কারিগরিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায়।
চলচ্চিত্র উৎসব নামে সে তো
উঁচু উঁচু মাথা উঁচু উঁচু কথা
শিল্পী নেতার ঝলমলে মেলা।
এইসব চলমান চিত্র
ঘটে,ঘটে যায়,ঘটতে থাকে
তুমি আমি রোজ দেখি
প্রতিনিয়ত এবেলা ওবেলা।
চলচ্চিত্র না চলমান চিত্র—
তুমি কোনটা নেবে
এইবার সোজাসাপ্টা বলো?
চলচ্চিত্র শুধু বসে বসে দেখা,
চলমান চিত্র সামনে ঘটতে দেখা—
কোনটা পছন্দের-অপছন্দের
কোনটা খারাপ,কোনটা ভালো?
প্রেক্ষাগৃহ ছাড়ো!
চলো হই চলমান, পাশাপাশি হাঁটি
দেখি,চলো চলমান চিত্রগুলো…