অবতক খবর,১২ মে, কলকাতা, সুমিত:মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের চাকরি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা নিয়োগের দাবীতে তারা পথে নেমেছে। বেশকিছু ধরে তাদের রাজধানী কলকাতার বিভিন্ন জায়গাব্জুড়ে আন্দোলন করতে দেখা যাচ্ছে। আর এদিন তারা জমায়েত হয়েছিল বিকাশ ভবন চত্বরে। মাদ্রাসার চাকরিপ্রার্থীদের এই দাবী দীর্ঘদিনের। কার্যত ২০১৪ সালে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন ৩১৮৩ টি সীটে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের পরীক্ষা নিয়েছিল। তারপর দীর্ঘ সময় পার করে ২০১৮ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হতে মাত্র ১৯০০ মতো শিক্ষক নিয়োগ করে বাকিদের বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় গ্যাজেটে উল্লেখ রয়েছে, চাকরিপ্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার আগের দিন পর্যন্ত ভ্যাকান্সি আপডেট করে নিয়োগ করা হবে। কিন্তু আপডেট তো দূর অস্ত ঘোষিত সীট পূরণ করা হয়নি।
এস এস সি চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন এবং আইনি লড়াইয়ের জেরে সরকার যখন বাধ্য হয়ে ভ্যাকান্সি না থাকা সত্ত্বেও বিধি ভেঙে নতুন ৬ হাজারেরও বেশি ভ্যাকান্সি বৃদ্ধি করে নিয়োগ কার্যকর করতে চলেছে। অন্যদিকে তার ঠিক তার উল্টোটা দেখা যাচ্ছে। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও দীর্ঘ আট বছর ধরে বঞ্চনার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরছেন মাদ্রাসার চাকরিপ্রার্থীরা। প্রাইমারির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে নট ইনক্লুডেড ক্যান্ডিডেটদের পরবর্তীকালে ১৬৫০০ জনকে নিয়োগ করা হয়েছে।
দুদিন আগে কলকাতায় ধর্মতলা প্রেসক্লাবের সামনে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করবে বলে জমায়েত হয়েছিল মাত্র। তারপরে ছিল তাদের অনশন কর্মসূচি। কিন্তু পুলিশ ততক্ষণাৎ তুলে নিয়ে লালবাজার থানায়। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, যেকোনো নিয়োগ সব সময়ের জন্য সুসংবাদ। কিন্তু এস এস সি র ক্ষেত্রে ২০১৬ সাল থেকে কয়েক দফায় নিয়োগ হয়েছে। সরকার আবার সমস্ত আন্দোলন কারীদের নিয়োগ দিচ্ছে, তাও আবার ভ্যাকান্সি বৃদ্ধি করে। অথচ সম ক্যাটাগরিতে পাশ করেও ম্যাদ্রাসার প্রশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। অথচ মাদ্রাসায় নিয়োগের ক্ষেত্রে ভ্যাকান্সি প্রস্তুত করার প্রয়োজন নেই। গ্যাজেট অনুযায়ী আপডেট ভ্যাকান্সিতে নিয়োগ দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। এস এস সি র ক্ষেত্রে ভ্যাকান্সি বাড়িয়ে নিয়োগ হচ্ছে আর অন্য দিকে মাদ্রাসার ক্ষেত্রে ঘোষিত ভ্যাকান্সি লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
বস্তুত মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন মাদ্রাসায় শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ করবে বলে ২০১৩ সালে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের ২০১৩ সালের বিজ্ঞপ্তির সময় ভ্যাকান্সি ছিল ৩১৮৩ এবং গেজেটে আরো উল্লেখ ছিল, লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট এর আগের দিন অর্থাৎ ০৫/০৯/২০১৬ পর্যন্ত শূন্যপদ আপডেট হবে তারপর নিয়োগ হবে। ২০১৬ তে লিখিত পরীক্ষা হয়, ২০১৭ এর শেষ দিকে ইন্টারভিউ হয়। কিন্তু ২০১৮তে নিয়োগ এবার সময় শূন্যপদ তো আপডেট হয়নি, বরঞ্চ কমিশন ২০১৩ সালের শূন্যপদ কে কমিয়ে ২০০০ এর কাছাকাছি রেকোমেন্ডেশন দেয়। মাদ্রাসা গুলোতে নিয়োগ হয় ১৫০০ এর কাছাকাছি। ফলে একদিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ বছর ধরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্য দিকে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের পাশ প্রার্থীরা তাদের চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন যেখানে ২০১৭ সালের আপডেট ভ্যাকান্সিতে নিয়োগ করেছিল সেখানে মাদ্রাসা গুলোতে ২০১৩ সালের ভ্যাকান্সি পূর্ণ করেনি। তদানিন্তন মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুর রৌফ চাকরিপ্রার্থীদের কোনো কথায় গুরুত্বপূর্ণ দেননি। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা সেই সময়ের মাদ্রাসা মন্ত্রী হিসাবে মাদ্রাসা গুলোকে শিক্ষক দেওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু কোনো নিয়োগ হয়নি আজ পর্যন্ত। দীর্ঘ ৮ বছর থেকে অসংখ্য মাদ্রাসায় ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল বাংলা, বিজ্ঞান, অঙ্ক, আরবির শিক্ষক নেই। অর্থাৎ মাদ্রাসাতে কোন ছাত্র পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়া পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকই পায়নি। কেবলমাত্র চাকরিপ্রার্থীরাই নয় অনেক মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের দাবী করে আসছে। তারা শিক্ষক না পাওয়ায় হাই কোর্টের দারস্থ হয়েছিলেন। মহামান্য হাইকোর্ট সাত দিনের মধ্যে মাদ্রাসা গুলোকে আপডেট ভ্যাকান্সিতে শিক্ষক দেওয়ার নির্দেশ দেয় কিন্তু কমিশনের চেয়ারম্যান মাদ্রাসা গুলোকে শিক্ষক না দিয়ে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের দারস্থ হয় সেই সাথে মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা উক্ত মাদ্রাসার সেক্রেটারী কে বিভিন্ন ভাবে অপদস্ত করতে থাকে। যে সমস্ত মাদ্রাসা আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিল, তাদের গ্রান্ট এডেড কেড়ে নেবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে মাদ্রাসার কর্ম ক্ষমতা রোধ করে দেওয়া হয়। আরো জানা গেছে যে, কমিশন বারংবার বলে আসছে, তারা বিজ্ঞাপনের আগের ভ্যাকান্সি অনুযায়ী নিয়োগ করেছে। তাই অনেক চাকরিপ্রার্থী বঞ্চিত হয়েছে৷। চাকরিপ্রার্থী অভিযোগ, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। কেননা তদন্ত করে দেখা হয়েছে, এমনকিছু শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ হয়েছে যাদের ২০১৪ সাল পর্যন্ত উক্ত মাদ্রাসায় ভ্যাকান্সি ছিল না। ২০১৮ সালে তা যোগ হয়েছে। চাকরিপ্রার্থী রা আরো বলেন, তৎকালীন মাদ্রাসার চেয়ারম্যন চাকরিপ্রার্থীদের ইচ্ছে করে বঞ্চিত করে রেখেছেন এবং উক্ত সীটগুলিতে ভুয়ো শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তার প্রমাণ সরকারের কাছেই রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, উক্ত কালপর্বে মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগের অধিকারকে কেন্দ্র করে ম্যানেজিং কমিটি বনাম মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন দ্বন্দ্ব চরম আকার নিলে তা সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। যতদিন রায় বেরোয়নি ততদিন কমিশন মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগের কর্মসূচি গ্রহন করতে বিলম্বিত করেছিল। তাই পরীক্ষা ২০১৪ সালে হলেও নিয়োগ করতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। এই সময়ে কমিশনের পক্ষে জোরালো আওয়াজ তুলেছিল বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন ফোরাম নামক একটি শিক্ষক সংগঠন। এটি ছিল মূলত মাদ্রাসার শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল এবং যাতে মাদ্রাসা ভবিষ্যৎ ম্যানেজিং কমিটির হাতে চলে না যায় এইজন্য তাদের বিভিন্ন সময় চাঁদা তুলে, কলকাতার বুকে আন্দোলন করতে দেখা যায়। নতুন চাকরিপ্রার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তাদের আন্দোলনে সামিল করে। যার ফলে ২০১৬ সালে লিখিত রেজাল্টের পর যারা পাশ করেছিলেন অর্থাৎ ৩৭০৬ জন চাকরিপ্রার্থী দিনরাত মেহনত করে, অর্থ ও শ্রম দিয়ে ফোরামের সভাগুলোকে সাফল্য মন্ডিত করে তুলতে ভিড় জমাতো। চাকরিপ্রার্থীরা আশা করেছিল, সংগঠিত হয়ে তারা সকলেই নিজের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারবে। এইজন্য তারা কমিটির বিরুদ্ধে কমিশনকে বাঁচাতে প্রচুর টাকা একত্রিত করে ফোরামের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু যখন মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট এর রায়ে কমিশন জিতে যায় এবং সুপ্রিমকোর্ট অর্ডার করে যে, যেহেতু মাদ্রাসায় প্রচুর ভ্যাকান্সি পড়ে রয়েছে, সুতরাং খুব দ্রুত ২০১৪ সালের তালিকাভুক্ত চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ করতে হবে। তখন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে অন্যদিকে শিক্ষক সংগঠনটি ম্যানেজিং কমিটির আগমনে চাকরির ক্ষেত্রে যে সংশয় তৈরি হয়েছিল, কমিশনের জয়লাভে তা কেটে গেলে, নতুন চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগের বিষয়ে হাত গুটিয়ে নেয়।
নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলে কমিশন সুপ্রিমকোর্টের অর্ডারকে অবজ্ঞা করে। এইজন্য বিভিন্ন সময় কোর্টে কমিশনের পদস্থ অফিসাররা অপমানিত হতে হয়েছে। তবুও চেয়ারম্যান গোয়ার্তমি করে গেছেন। চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি অমানবিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা তখন কলকাতার বুকে আন্দোলন মিছিল মিটিং শুরু করে। তারা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধির সাথে দেখা করেন। কমিশনে বারবার ডেপুটেশন দিতে থাকেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই মেলে নি। অত:পর হবু শিক্ষকগণ হাইকোর্টের দারস্থ হন। আবার মহামান্য হাইকোর্ট ১৯০ জনের নিয়োগের বিবেচনা করার নির্দেশ দেন এবং ৬ সপ্তাহের মধ্যে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে বলেন। তবুও সুরাহা হিয়নি। চাকরিপ্রার্থীরা বিভিন্ন দপ্তরে ছোটাছুটি করতে থাকেন। একটা সময় চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷ উপরন্তু কমিশনের চেয়ারম্যান চাকরিপ্রার্থীদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন, নিয়োগ দেবেন না।
পরবর্তীকালে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী রা প্রেসক্লাবে র সামনে অনশনে বসেছিল। কিন্তু সেই অনশন মঞ্চে ভোরের নামাজরত আন্দোলন কারীর উপর পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ।। এস এস সি র আন্দোলনকারীদের অনশন ভাঙার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নিজে উপস্থিত হয়ে ফলের ফলের রস খাইয়ে অনশন ভাঙতে বললেন, তার কুড়ি হাত দূরে মাদ্রাসার অনশনকারীদের দিকে ফিরে তাকালেন না। বরং চাকরিপ্রার্থীরা খেল গলাধাক্কা। লাঠিপেটা, বন্দুক উচিয়ে ধরা সম্পর্কে সকলেই অবগত। এরপর কমিশনের চেয়ারম্যান বদলি হয়। তারপরেও ডেপুটেশন দেওয়া হয়। বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে নেতামন্ত্রীদের কাছে যাওয়া হয়, কিন্তু কোনো কাজের কাজ হয়। অবশেষে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা নিরাষ হয়ে সোসাল মিডিয়াকে আন্দোলনের মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিল।
কিন্তু বর্তমানে সরকার যখন এস এস সি র চাকরিপ্রার্থীদের ভ্যাকান্সি ক্রিয়েট করে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে তাহলে তারাই বা কেন শুনবে! তাই এবার জোরালো আবেদন নিয়ে এদিন কলকাতার বুকে জমায়েত হয়েছিল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে পুলিশ এসে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করার জন্য ধরপাকড় শুরু করে এবং ধরে নিয়ে যায় লালবাজার থানায়। পরের দিন চাকরিপ্রার্থীরা আন্দোলনের জন্য বেছে নেয় হাজরা মোড় কে। সেখানে তারা সমাবেশ শুরু করতেই পুলিশ তাদের ধরে তুলে নিয়ে যায়। কোনো মতেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাদের আবেদন পৌছতে দেওয়া হয়নি। তারপর রাত্রী আট টার পর চাকরিপ্রার্থীদের শিয়ালদহ তে রেখে যায়। আর আজকে চাকরিপ্রার্থীরা জমায়েত হয়েছিল কয়েকটি ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে। যাতে পুলিশ তাদের কোনঠাসা না করে দেয়। এদিনও পুলিশ বাধা দিতে থাকে। কিন্তু চাকরিপ্রার্থীরা বিকাশ ভবনে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের দপ্তরে তাদের ডেপুটেশন দিতে সক্ষম হয়। আন্দোলন রত চাকরিপ্রার্থী দের দাবী, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এস এস সি এবং প্রাইমারির ক্ষেত্রে মানবিক দৃষ্টিতে চেয়েছেন বলে তারা নিয়োগ পাচ্ছে, তবে মাদ্রাসার চাকরিপ্রার্থীরা কেন নয়? একই রাজ্যে, একই মুখ্যমন্ত্রীর সময়ে, সম ক্যাটাগরিতে পাস করে এস এস সি উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা নিয়োগ পাচ্ছে, অথচ মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থী রা কেন বঞ্চিত। আন্দোলনকারীরা বলে জানিয়েছেন।