স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষঃ পর্ব ১১
যে অগ্নিকন্যার মৃতদেহ পড়েছিল ঋষিকেশের রাস্তায়
তমাল সাহা
তুই বড় জেদি মেয়ে, খুব একগুঁয়ে ছিলি তুই। তাতে তোরই বা দোষ কি? কল্যাণী-দি ছিল পাশে। রুদ্রতেজে করে যাচ্ছিল দেশের কাজ। দাদাও ছিল মুক্তি সংগ্রামী। এসব তো নিশ্চিত তোর উপর ফেলেছিল প্রভাব।
বাবাও কি কম যায়? সে তো অগ্নিপুরুষ। সুভাষচন্দ্রকে দিয়েছিল দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষা।বাবা তো সমকালীন ব্যক্তিত্ব বেণীমাধব দাস। এভাবেই গল্পটা শুরু।
আগুনের পাশে থাকলে উত্তাপ ছড়িয়ে যায়। বেথুন কলেজে পড়ে মেয়ে। ১৯২৮ সাল। বয়স তো সবে সতেরো। তুমি দল গড়ো। সাইমন কমিশন বয়কট করো। সহপাঠীদের নিয়ে পিকেটিং করো। তারপর তো ঢুকে গেল বৈপ্লবিক চিন্তা। সুহাসিনী দত্ত, শান্তি দাশগুপ্তদের সঙ্গে ছোট ছোট আলোচনা। এরপর আরো বড় বিপ্লবী দল যুগান্তরের দলের খপ্পরে পড়ে গেলে আর কমলা দাশগুপ্ত দেখলেন, এ মেয়ে তো সে মেয়ে নয়, এই পারবে সুনিশ্চয়।
সহযোদ্ধা সুধীর ঘোষের সাহায্যে যোগাড় করলেন পিস্তল। দাম ২৮০ টাকা। সুধীর ঘোষ বলেন, আরে বীণা পারবি তো তুই! বীণা হাতে তুলে নিল শেষ পর্যন্ত— অগ্নিবীণা। ব্রিটিশের অত্যাচারের প্রতিভূ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য– হত্যা করতে হবে তাকে।
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২। সমাবর্তন উৎসব যাকে বলে কনভোকেশন। সিনেট হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। চ্যান্সেলর গভর্নর জেনারেল জ্যাকসন অভিভাষণ পাঠ শুরু করলেন। কনভোকেশনের গাউন পরা বীণা বসে আছে আসনে। কোথায় পিস্তল? পিস্তল লুকানো আছে গ্রন্থিত কবরীতে– খোঁপায়। দ্রুতগামী বীণা, হাতে পিস্তল। বেরিয়ে গেল কার্তুজ গভর্নরের কানের পাশ দিয়ে। আতঙ্কে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়লেন গভর্নর তবুও থামেনি গুলি। পরপর পাঁচটি দুম দুম শব্দে বেরিয়ে গেল কিন্তু সবই লক্ষ্যভ্রষ্ট।
ধরা পড়ে গেল ভাইস চ্যান্সেলর হাসান সোরাবর্দির হাতে। বীণা স্বীকার করে নিল দায়। বলে, স্বাধীনতার জন্য নিশ্চিত আত্মবলি দেওয়া যায়।
কিন্তু পিস্তল পেলে কোথায়? নিরুত্তর বীণা। ৯ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, জেলের ঘানি টেনেছিল সে।
মুক্ত তো হয়েছিল সে কিন্তু মুক্তি পেয়েছিল কি? জড়িয়ে পড়লো শ্রমিক-উদ্বাস্তুআন্দোলনে, বস্তিবাসীদের পাশে ছিল সে। অমৃতবাজার সংবাদপত্র কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতিও হয়েছিল। নোয়াখালির দাঙ্গায় অসহায় মানুষের পাশে ছিল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও যুক্ত হয়েছিল
তারপর সেই বিখ্যাত রাজনৈতিক পত্রিকা মন্দিরা, তাতে লিখত সে। সম্পাদনা করতেন কমলা দাশগুপ্ত।
স্বাধীনতা সংগ্রামীর তাম্রপত্র ও পেনশন উপেক্ষা করেছিল সে।
৮১ বছর পর মরণোত্তর স্নাতক শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল তাকে। হায়! সেই কনভোকেশনের দিন সে বলেছিল, ধেত্তেরি তোর শংসাপত্র! দেশের চেয়ে কি শংসাপত্র বড়?
অগ্নিকন্যারা কি হারিয়ে যায়? আমি এর কি উত্তর দেবো, মুখ লুকিয়ে রাখি আস্তিনের তলায়।
শেষ জীবনে অসহায় নিঃসঙ্গ বীণার মৃতদেহ পড়েছিল ঋষিকেশের রাস্তায়। অনেক কঠিন শ্রমে তাকে শনাক্ত করা যায়– কোনোদিন সে অগ্নিকন্যা ছিল, তা জানতে পারা যায়!
ভারতবর্ষ!কাঁদো, তুমি আরো কাঁদো।