শ্রদ্ধা নিবেদনঃ

অবিসম্বাদিত যাত্রাপালা লেখক ব্রজেন্দ্র কুমার দে। কাঁচরাপাড়ার জনজীবনে এক সুপরিচিত নাম।আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস।১২ মার্চ ১৯৭৬ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

সেই অবিস্মরণীয় যাত্রা পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে
কাঁচরাপাড়ায়
তমাল সাহা

ব্রজেন্দ্র কুমার দে যাত্রাপালাকার। যাত্রা ও ব্রজেন দে বাংলার ইতিহাসে পরস্পরের পরিপূরক। ১২ই মার্চ তাঁর প্রয়াণ হয়েছিল।

যাত্রাপালার শুরুতে যখন জগঝম্প বেজে ওঠে তখন তোমার কথাই মনে পড়ে। সম্মিলিত বাদ্যযন্ত্রের সুরের মধ্যে খুঁজে পাই বাংলার মুখ এবং তোমাকে। জেনেছি পৌরাণিক, সামাজিক ঘটনাগুলির মধ্যে চোরাস্রোতে তুমি বইয়ে দিতে সমসাময়িকতা। মানব জীবনের বাস্তবতা এবং চলমান সমাজের প্রেক্ষিত।

যতদূর জানি জীবনভর তুমি লিখে গেছো একশো পঁচানব্বইটি যাত্রাপালা। তুমি কোনো পার্টি করতে কি না জানা নেই তবে তুমি যে বিভিন্ন যাত্রাপার্টির কাছের মানুষ ছিলে তা সোচ্চার ছিল বাংলার মানুষের কাছে।

যাত্রাপালাকার হিসেবে সুপরিচিত হলেও তুমি যে নিজেই একজন জাত অভিনেতা তা কজন জানে! ১৯৩৬ সালে ভোলানাথ অপেরায় তোমার জবরদস্ত অভিনয় এখন ইতিহাস। এমন এক সময় গেছে, তুমি আর নট্ট কোম্পানি পরিপূরক হয়ে উঠেছিলে।

১৯৩৪ সাল। ‘লীলাবসান’! যাত্রাপালা রচনার জন্য লালমুখো পুলিশ তোমায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিল লালবাজারে। ইছাপুর নর্থ লেন স্কুলের হেডমাস্টারমশাই হয়েও যাত্রার জগতে একচ্ছত্র পালাকার হিসেবে ছড়ি ঘুরিয়ে গিয়েছো।

তোমার রচিত ‘দেবতার গ্রাস’-এ বেয়াল্লিশের বিপ্লবের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছি। ‘আকালের দেশ’-এ খুঁজে পেয়েছি পঞ্চাশের মন্বন্তরের দৃশ্য। ‘মায়ের ডাক’-এ সুভাষের কন্ঠস্বর আজও বাতাসে ভাসে।

১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলে তুমি। ইন্দিরা গান্ধীকে কেন্দ্র করে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উপজীব্য করে তোমার যাত্রাপালা ‘কাজির বিচার’ ও ‘নন্দকুমারের ফাঁসি’ যাত্রা জগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা।

তোমাকে নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল বুদ্ধিজীবী মহলে। কারণ ১৯৪৭-এ অম্বিকা নাট্য কোম্পানি অভিনীত বিদ্রোহী নজরুল পালায় কবি মোহিতলালকে তুমি প্রতিক্রিয়াশীল বলে চিত্রায়িত করেছিলে। এই পালাকে নিয়ে মামলা করেছিলেন মোহিতলাল পুত্র। কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলে তুমি। কিন্তু মৃত্যু তার আগেই তোমাকে নিয়ে যায়।

এই তোমাকেই ‘জাস্টিস অফ পিস’ হবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ১৯৫৩ তে। তুমি তা অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলে।

যাত্রার মানুষ তুমি। যাত্রা নিয়েই হোক শেষ কথা। ১৯৭৩। নটী বিনোদিনীকে তুমি নিয়ে এলে জনতার সামনে। নট্ট কোম্পানির অভিনেত্রী বীণা দাশগুপ্তা এবং বিনোদিনী হয়ে গেল একাকার। বিনোদিনীর সাংস্কৃতিক চেতনা ও সংস্কৃতির প্রসারের স্বার্থে তাঁর বিস্তীর্ণ হৃদয়ের কথা শুনিয়ে গেলে তুমি। আর সে বৎসরই বিজয় পালক শোভিত শিরোপা পেলে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান।

সেই নটী বিনোদিনী চলে এলো কাঁচরাপাড়ায়। রামকৃষ্ণ স্পোর্টিং ক্লাবের আয়োজনে কবরখানা ময়দানে। স্থান সংকুলানের অভাবে ব্যাপক দর্শক সমাগমে উত্তেজনায় ভেস্তে গেল অভিনয়। কিন্তু নটী বিনোদিনীকে ভুলবে কে?
আবার অভিনীত হলো ‘নটী বিনোদিনী’। এবার অভিনীত হলো মান্ধারীর মাঠে।

কাঁচরাপাড়া তোমায় দেখেছিল একদিন। ১৯৭৫ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর কবরখানা ময়দানে। তোমায় সম্বর্ধিত করেছিল। সেদিন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মোহন অপেরার ‘সীতার বমবাস’। অসংস্কৃতির এই বেলেল্লাপনার সময়ে বাংলার লোকসংস্কৃতির রূপকার তোমাকে মনে পড়ে।

সঙ্গের ছবিটি সংগ্রহ করে দিয়েছেন ব্রজেন্দ্র কুমার দের পুত্র তরুণ কুমার দে। বাঁদিক থেকে অভিনেতা নিতাই দাস, শিরোপাখচিত ব্রজেন্দ্র কুমার দে, অভিনেতা ও ম্যানেজার মধু বড়াল এবং অভিনেতা প্রবীর শীল।